৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১১:৫৭:২৯ পূর্বাহ্ন


মেঘের রাজ্যে স্মৃতিঘন দিনগুলো
তানভীর আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৭-২০২৫
মেঘের রাজ্যে স্মৃতিঘন দিনগুলো ভ্রমণে লেখক ও অন্যরা


ঢাকা মহানগরীর কংক্রিট জিঞ্জিরায় সকাল-সন্ধ্যা নানাকাজে ব্যস্ত থেকে ইচ্ছা জাগে মহানগরীর যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে অবসর করতে। যেখানে থাকবে শুধু প্রকৃতি, শান্তি আর প্রশান্তি। প্রকৌশলী সংসদ লিমিটেড আমাদের কর্মস্থল। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বরাবরই আমাদের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ এবং প্রেরণাদায়ক। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনের আনন্দময় সফরের স্মৃতি নিয়ে ফেরার পরই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পরবর্তী বিনোদন সফরে যাওয়া হবে পাহাড়ের দেশ-সাজেক ভ্যালিতে। সবাই জানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় বনবনানি সুশোভিত সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র। পরিকল্পনা করি জানুয়ারি ২০০৫ মাসে আমরা ৮০ জন সহকর্মী, আমাদের পরিবার ও ব্যবস্থাপনাধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে পাঁচদিনের ভ্রমণ সফরের তারিখ নির্ধারিত হয়: ৯ জানুয়ারি রাতের যাত্রা, ফিরতি ১৪ জানুয়ারি ২০২৫। বিশ্বাস করুন নাই বা করুন আমাদের যারা কাশ্মীর, নিউ জিল্যান্ডের উত্তর দ্বীপপুঞ্জ বা সুইজারল্যান্ড সফরের সামর্থ্য বা সুযোগ নেই তাদের জন্য সাজেক দিতে পারে একই মাত্রার বিনোদন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ জানুয়ারি রাত ১১টায় ঢাকা মিরপুর থেকে হুন্ডাই ব্র্যান্ডের দুটি রিজার্ভ বাসে চেপে আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা দিই। আনন্দ বিনোদন হাসি, গল্প আর গানে কেটে যায় সময়। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি সকালে পৌঁছে যাই খাগড়াছড়ি শহরে। খাগড়াছড়ি পাহাড়ের শহরে সকালবেলা পৌঁছে খাগড়াছড়িতে, নাস্তার পর চেক-ইন করি আগে থেকেই বুকড করা হোটেল অরণ্য বিলাস ও হোটেল মাউন্ট ইন-এ। কিছু সময় বিশ্রামের পর চাঁদের গাড়িতে শুরু হয় আমাদের খাগড়াছড়ি দর্শন: দিনব্যাপী সফর সূচিতে ছিল সাফা পুকুর শান্ত পরিবেশে ঘেরা এ পুকুর ও পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধবিহার আমাদের মনকে মুহূর্তেই প্রশান্ত করে তোলে। আলুটিলা গুহা আলো-আঁধারিতে মোড়া এ গুহা ও ঠান্ডা বাতাস আমাদের সবাইকে রোমাঞ্চিত করে তোলে। রিছাং ঝরনা-সবুজ পাহাড়ের কোলে গড়িয়ে পড়া জলধারা আমাদের ক্লান্ত শরীর ও মন দুটোকেই একবারে তরতাজা করে দেয়।

দুপুরে আমরা খাই খাগড়াছড়ির বিখ্যাত বাঁশে রান্না করা মুরগি, পাহাড়ি ভর্তা ও ভাত। বিকাল কাটাই খাগড়াছড়ি টাউন লেক ও বাজার এলাকা। দিনশেষে রাতটি কাটে হোটেলে, ফিরে পরদিন ভোরে সাজেক যাত্রার প্রস্তুতি নিতে হয়। ১১ জানুয়ারি সকালে: চাঁদের গাড়িতে সাজেক যাত্রা ছিল অনাবিল আকর্ষণের অবিস্মরণীয় স্মৃতি। সকাল ৭টায় হোটেল থেকে চেক-আউট করে হালকা নাশতা সেরে আমরা রিজার্ভ চাঁদের গাড়িতে চেপে রওনা দিই সাজেক ভ্যালির পথে। তিন ঘণ্টার পাহাড়ি রাস্তা-একদিকে ঢালু খাদ, পাশে সবুজ পাহাড় আর মাঝেমধ্যে সাদা মেঘ মনে হয়েছে রুকথার রাজ্য দর্শনে আমরা। দুপুর নাগাদ পৌঁছাই সাজেক। আমরা ছিলাম তিনটি রিসোর্টে-গাবা রিসোর্ট, সাজেক বিলাস এবং কাসালং রিসোর্টে। ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় প্রতিটি রিসোর্ট ছিল অনাবিল আকর্ষণের।

দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা বিকালে যাই সাজেকের আইকনিক হেলিপ্যাডে সূর্যাস্ত দেখতে। পাহাড়ের আড়ালে অস্তগামী সূর্য, লাল-কমলা রংধনু আলোয় রাঙানো মেঘের খেলা-সব মিলিয়ে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। ১২ জানুয়ারি সূচিতে ছিল কংলাক ট্র্যাকিং, বারবিকিউ, লোকসংগীত ও পাহাড়ি খাবার। ভোর ৫টায় হেলিপ্যাডে গিয়ে সূর্যোদয়ের অসাধারণ দৃশ্য দেখি। এরপর সকালের নাশতা সেরে রওনা দিই সাজেকের সর্বোচ্চ স্থান কংলাক পাহাড়ে ট্র্যাকিং করতে।

কিছুটা চড়াই পথ পেরিয়ে পৌঁছাই কংলাক টপে। ওপরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমরা মেঘের মাঝখানে, চারপাশে শুধুই সাদা সাদা ঢেউয়ের মতো মেঘ আর দূরে সবুজ পাহাড়ের রেখা। দুপুরে খাই বাঁশে রান্না করা মুরগি, ব্যামবো রাইস, পাহাড়ি শাক-খুবই সুস্বাদু ও স্বতন্ত্র। সন্ধ্যায় ছিল আমাদের সফরের অন্যতম আকর্ষণ-বারবিকিউ ও পাহাড়ি লোকসংগীত সন্ধ্যা। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ছোট্ট ক্যাম্পফায়ার ঘিরে আয়োজন করা হয় বারবিকিউ। পরিবেশন করা হয় দেশি মুরগি ও গরুর মাংস, সঙ্গে পরোটা, চাটনি ও সালাদ। স্থানীয় দুইজন তরুণ তাদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসে পরিবেশন করেন পাহাড়ি গান-কখনো লুসাই ভাষায়, কখনো বাঙালি লোকসুরে। আমরা সবাই সে সুরে গলা মিলিয়ে মেতে উঠি আনন্দ-উল্লাসে। এ মুহূর্তগুলোর কথা সহজে ভোলার নয়।

১৩ জানুয়ারি ছিল নিরিবিলি দিন, হস্তশিল্প ও স্মৃতিস্নাত রাত। সকালের পর অনেকেই ব্যক্তিগত সময় কাটান। কেউ পাহাড়ের পাশে হেঁটে যান, কেউ রিসোর্টের বারান্দায় বসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে মেঘে হারিয়ে যান। বিকালে আমরা যাই সাজেক বাজারে। সেখান থেকে কিনি স্থানীয় হস্তশিল্প, কাঠের শোপিস, আদিবাসী পোশাক, বোনা কাপড় ও পাহাড়ি ফলমূল। রাতে উপভোগ করি বিশেষ ডিনার-ভুনা খিচুড়ি, পাহাড়ি হাঁসের মাংস, গরুর মাংস, চাটনি ও সালাদ। ভিন্ন স্বাদের এ খাবার আমাদের ভ্রমণকে আরো পরিপূর্ণ করে তোলে। এভাবেই সাঙ্গ হয় বিনোদন মেলা।

১৪ জানুয়ারি পাহাড় মেঘরাজ্য ছুঁয়ে ফেরা; বেলা ১১টায় আমরা চাঁদের গাড়িতে খাগড়াছড়ির পথে রওনা দিই। সাজেক থেকে বিদায়ের মুহূর্তে কারো মুখে কোনো শব্দ ছিল না-শুধু মন ভার। যেন আত্মার আত্মীয় বিরহ-বেদনা। খাগড়াছড়ি পৌঁছে দুপুরে খেয়ে আবার বাসে ঢাকার পথে যাত্রা করি। সকাল ৬টায় পৌঁছাই নিজ নিজ গন্তব্যে।

মেঘে মিশে থাকা অনুভূতি: সাজেক কোনো সাধারণ পর্যটন স্থান নয়-এটি একটি অনুভব। এখানে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য, পাহাড়ের উচ্চতা, মেঘের কোমলতা আর মানুষের আন্তরিকতা-সব মিলিয়ে তৈরি হয় এমন এক অভিজ্ঞতা, যা জীবনের ক্লান্ত দিনগুলোতেও মনে প্রশান্তির বাতাস এনে দেয়। এ পাঁচদিনের ভ্রমণ আমাদের কাজের ক্লান্তি দূর করেছে, সৃষ্টি করেছে সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধন ও ভরসা। নতুন উদ্যমে ফিরেছি কর্মজীবনে-হৃদয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি বাতাসের ছোঁয়া।

শেয়ার করুন