মনু মিয়া একজন কবর খোঁড়া মানুষ, যিনি জীবনভর কাজ করেছেন নিরলসভাবে, নিঃস্বার্থভাবে। তার অসুস্থতার খবর পেয়ে দেখতে যান অভিনেতা খায়রুল বাসার। সেখানে গড়ে ওঠে এক হৃদয়ের সম্পর্ক, উঠে আসে জীবনের প্রতি মনু মিয়ার গভীর দর্শন ও আত্মমর্যাদার গল্প। এ নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন খায়রুল বাসার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: আপনি মনু মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কীভাবে জানলেন তাঁর অসুস্থতার খবর?
খায়রুল বাসার: গণমাধ্যমেই প্রথম মনু মিয়ার সংবাদটি দেখি। তিন হাজার ৫৭টি কবর খুঁড়ে যিনি জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন, তাঁর সঙ্গে এমন নির্মম ঘটনা-ঘোড়াটি মেরে ফেলা হয়েছে-আমাকে নাড়া দেয়। তখনই সিদ্ধান্ত নেই, তাঁকে দেখতে যাব।
প্রশ্ন: সাক্ষাতে গিয়ে কেমন লাগল?
বাসার: প্রথম দেখাতেই এক আত্মার আত্মীয়ের মতো অনুভব করি তাঁকে। আমি মজা করে বললাম, “আপনি মনু মিয়ার কী হন?” তিনি সঙ্গে সঙ্গে হেসে জবাব দিলেন, “আরে ফাগল, আমিই তো মনু মিয়া।” এরপর থেকেই আমাদের আড্ডা জমে ওঠে। একদম প্রাণবন্ত, চিন্তাশীল একজন মানুষ।
প্রশ্ন: তাঁর ঘোড়াটি মারা যাওয়ার ঘটনায় আপনি অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন...
বাসার: হ্যাঁ, এটা খুবই কষ্টের খবর ছিল। তিনি সেই ঘোড়াটিকে দীর্ঘ সময় নিজের সঙ্গী হিসেবে রেখেছিলেন, প্রতিটি কবর খুঁড়তে সেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে যেতেন। আমি তখন তাঁকে বলি, “আমি আপনাকে একটা ঘোড়া কিনে দিতে চাই।” কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, “আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে নিজের টাকায় সাতটা ঘোড়া কিনতে পারব।” তাঁর এই আত্মবিশ্বাস, এই আত্মসম্মানবোধ-অসাধারণ।
প্রশ্ন: তাঁর কথা বা জীবনদর্শন আপনাকে কতটা নাড়া দিয়েছে?
বাসার: খুব গভীরভাবে। তিনি বলেন, “যার আছে, তারই যায়।” ঘোড়ার মৃত্যু নিয়ে তাঁর কোনো দুঃখ নেই। বরং তিনি বলেন, “এটা আমার কপালে ছিল। কে মেরেছে আমি দেখিনি, কাকে দোষ দেব?” আমি হতবাক হয়ে যাই। এই সহজ-সরল অথচ প্রজ্ঞাভরা দর্শন আমাদের অনেককেই শিক্ষা দিতে পারে।
প্রশ্ন: এমন একজন মানুষের কাছ থেকে আপনি কী শিখলেন?
বাসার: নির্লোভ থাকা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা-এই তিনটি জিনিস আমি খুব স্পষ্টভাবে তাঁর মধ্যে দেখেছি। তিনি জীবনে কারও ক্ষতি করেননি, কোনোদিন অনুদান নেন না, এমনকি খাবারের অনিয়ম করেও কবর খুঁড়তে ছুটে যান। এটাই তাঁর কাছে সেবা। এই মানসিকতা সমাজে দুর্লভ।
প্রশ্ন: তাঁর কোনো শখ বা স্বপ্নের কথা জানালেন?
বাসার: হ্যাঁ, একটি স্বপ্ন খুব স্পষ্ট করে বললেন-তিনি হজে যেতে চান। তবে সেটিও কারও সাহায্যে নয়, নিজের মতো করে, নিজের টাকায়। তাঁর কাছে শখ মানে শুধু বিলাস নয়, বরং একটা আত্মিক তৃপ্তি। যেমন তিনি হরিণের শিং দিয়ে লাঠি, হাতির দাঁতের ছুরি বানিয়েছেন-শুধু নিজের তৃপ্তির জন্য। এসবের পেছনে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করেছেন।
প্রশ্ন: আপনি বলেছিলেন, সমাজের আসল নায়ক তাঁরাই...
বাসার: একদম। মনু মিয়ার মতো মানুষরা সমাজের নায়ক-নিঃস্বার্থ, আত্মপ্রত্যয়ী, নির্ভীক। তাঁরা আলো ছড়ান, কিন্তু নিজে আলো হতে চান না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের মতো শিল্পীদের, তরুণ প্রজন্মের, এমন মানুষের জীবনদর্শন থেকে শেখার আছে।