৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪৯:৫৩ অপরাহ্ন


‘দ্য লন্ডন ক্লিনিক’ কেন?
হুইলচেয়ার ছাড়াই হাঁটছেন খালেদা জিয়া
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০১-২০২৫
হুইলচেয়ার ছাড়াই হাঁটছেন খালেদা জিয়া খালেদা জিয়া


‘ক্লিনিক’ শব্দটা বাংলাদেশে বহুল পরিচিত। শহর ছাড়াও গ্রামগঞ্জেও ক্লিনিক ও চিকিৎসা-ব্যবস্থা বেশ জমজমাট বাংলাদেশে। আমজনতা এসব স্থানে নিয়ে থাকেন চিকিৎসা। ফলে হঠাৎ কেউ ক্লিনিক শব্দটা শুনলে একটু ভ্রু কুঁচকেই তাকাবেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ক্লিনিকে? কেন বড় কোনো হাসপাতালে হতে পারতো না? এ প্রশ্নটা বেশ চলেছেও। 

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা লন্ডনে হবে এমন একটা আভাস দেওয়া হয়েছিল। তবে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রের নাম বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছিল। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত লন্ডনেই যাবেন প্রথম এবং লন্ডনে রওয়ানা দেওয়ার পর লন্ডন ক্লিনিকের নাম প্রচারিত হয়- যেখানে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। সব ভেবেচিন্তে ও তার চিকিৎসার সঙ্গে নিয়োজিত থাকা দেশ-বিদেশের পরামর্শকদের সিদ্ধান্তক্রমেই তাকে ‘দ্য লন্ডন ক্লিনিক’-এ চিকিৎসা প্রদান। এখান থেকে পর্যাপ্ত উন্নতি ঘটলে এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাবেন। 

লন্ডন ক্লিনিক কেমন? 

প্রতিষ্ঠার ৯৩ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে চলা লন্ডন ক্লিনিকটা ওয়েস্টমিনস্টার অঞ্চলে স্থাপিত। মূলত খুবই উন্নতমানের ও প্রসিদ্ধ ও নামীদামিদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত এ ক্লিনিক। এখানে ব্রিটেনের রয়্যাল ফ্যামিলির সদস্যদেরও চিকিৎসা দেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালটি কেবল চিকিৎসার মানেই বিখ্যাত নয়; এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন রাজা তৃতীয় চার্লস, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, ডিউক অব এডিনবরা, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, এলিজাবেথ টেইলর, প্রিন্স এডওয়ার্ড, প্রিন্সেস মার্গারেট, প্রিন্স ফিলিপ, ওয়েন্ডি রিচার্ড, স্যার অ্যান্থনি ইডেন প্রমুখ প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা ছাড়াও হলিউডের কিংবদন্তিরা। এমনকি সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, এমা ওয়াল্টন হ্যামিলটন এই হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। ফলে এটা শুধু এখনই নয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দক্ষ চিকিৎসক এবং উন্নত সেবার জন্য দ্য লন্ডন ক্লিনিক বিশ্বজুড়ে একটি নির্ভরযোগ্য নাম। 

খালেদা জিয়ার চিকিৎসক কে? 

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিসসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন তিনি। বিশ্বের খ্যাতিমান হাসপাতাল দ্য লন্ডন ক্লিনিকে তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে প্রখ্যাত লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডির তত্ত্বাবধানে। প্রফেসর প্যাট্রিক কেনেডি লিভারের ভাইরাসজনিত রোগ নিয়ে গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর লন্ডনে পোস্ট গ্রাজুয়েট প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। ২০০৯ সালে বার্টস অ্যান্ড দ্য লন্ডন স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড ডেন্টিস্ট্রিতে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।

সব শেষে লন্ডনেই চিকিৎসা 

এর আগে বাংলাদেশ সময় বুধবার (৮ জানুয়ারি) দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে লন্ডনের হিথরো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে খালেদা জিয়াকে বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মায়ের দেখা পেয়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেন ছেলে তারেক ও পুত্রবধূ জোবাইদা। একে অপরের দেখা পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা ও ছেলে উভয়েই।

কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

৮ জানুয়ারি স্থানীয় সময় সকালে লন্ডন পৌঁছলে তারেক রহমান ও ডা. জোবাইদার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনকে শুভেচ্ছা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মোহাম্মদ হজরত আলী খানসহ বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি এম এ মালেক ও সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমদসহ দলটির অনেক নেতাকর্মী।

গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ৪৬ মিনিটে কাতারের আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিয়ে যেতে কয়েক বছর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। এ নিয়ে বিএনপি আন্দোলনও করে। কিন্তু তাতে কান দেয়নি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। 

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে বিদেশ গিয়ে তার চিকিৎসা নেওয়ার পথ সুগম হলো।

লন্ডনে পরিবারের সান্নিধ্যে খালেদা জিয়া 

শেখ হাসিনা সরকারের দেওয়া আদালতের রায়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়ার সান্নিধ্যে আসতে পারেননি বড় ছেলে তারেক রহমান। আরাফাত রহমান কোকো তো বেঁচেই নেই। তারেক ও বড় পুত্রবধূ জোবাইদা রহমানও এ সময় ঢাকায় আসতে পারেননি। তারেকের বিরুদ্ধে তো মামলা ছিলই, জোবাইদার বিরুদ্ধেও ছিল মামলা। ফলে কোকোর স্ত্রী শর্মিলাই আসা যাওয়া করতেন। এবার লন্ডনে বড় ছেলে, পুত্রবধূ, নাতনিদের কাছে পেয়েছেন খালেদা জিয়া। পরিবারের সদস্যদের কাছে পেয়ে খালেদা জিয়া মানসিকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। একই সঙ্গে ক্লিনিকে তারেক রহমানের বাসায় রান্না করা খাবার তিনি নিয়মিত গ্রহণ করেন। লন্ডনে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাবেন খালেদা জিয়া। 

খালেদা জিয়ার উন্নতি 

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্য বিএনপির একজন নেতা জানান, পুরোপুরি চিকিৎসা এখনো শুরু না হলেও হাসপাতালে ভর্তির পর খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে, থেরাপি দেওয়ার পর খালেদা জিয়া হালকা হাঁটাহাঁটি করেছেন। তবে লন্ডন ক্লিনিকে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের আশাব্যঞ্জক উন্নতি হয়েছে বলেই মনে করছে তার সঙ্গে থাকা চিকিৎসকবৃন্দ। 

যুক্তরাজ্য বিএনপির সেক্রেটারি কয়সর এম আহমদ সাংবাদিকদের জানান, ছেলে-ছেলের বউ এবং নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন খালেদা জিয়া। প্রতিদিনই তারা হাসপাতালে আসছেন। মানসিকভাবে আগের চেয়ে অনেক সুস্থ আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

হুইলচেয়ার ছাড়াই হাঁটছেন খালেদা জিয়া, লিভার প্রতিস্থাপনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি

লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগের চেয়ে ভালো আছেন। হুইলচেয়ার ও কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি হাঁটতে পারছেন। তবে তাঁর লিভার প্রতিস্থাপনের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেলেই সরাসরি লন্ডনে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় যাবেন খালেদা জিয়া। সেখানে তিনি আরও কিছু সময় থাকবেন। 

এসব তথ্য জানিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক বলেন, সব পরীক্ষার প্রতিবেদন এখনও হাতে আসেনি। তবে যতগুলোর প্রতিবেদন এসেছে, উদ্বেগের কিছু নেই। এখানে অনেক ভালো থরো চেকআপ (পুরো শরীর) হচ্ছে। হাসপাতালের পরিবেশও ভালো। এতে তিনি ভালো বোধ করছেন। কারও সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে পারছেন। তবে ওয়াশরুম কিংবা অন্য জরুরি জায়গায় গেলে সাহায্য নিতে হয়। ছেলে ও পুত্রবধূ বাসা থেকে নিয়মিত খাবার নিয়ে আসছেন। 

তিনি বলেন, সব পরীক্ষার প্রতিবেদন আসার পর লিভার প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেবে মেডিকেল বোর্ড। ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেলে তিনি সরাসরি ছেলের বাসায় যাবেন। 

এদিকে, গত ১৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়া মানসিক ও শারীরিক অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।

বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ম্যাডাম আগের চেয়ে ভালো আছেন। রুটিন বিভিন্ন পরীক্ষাগুলো চিকিৎসকরা করছেন। তাঁর চিকিৎসার ধরনে কিছুটা পরিবর্তনও আনা হয়েছে। 

৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ জানুয়ারি তাঁকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জন প্যাট্রিক কেনেডির তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চলছে।

শেয়ার করুন