১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৩:৪৬:০২ পূর্বাহ্ন


আ.লীগের জন্য হিতে বিপরীত হলো যে ঘটনা
এস এম এম
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-১১-২০২৪
আ.লীগের জন্য হিতে বিপরীত হলো যে ঘটনা জিরো পয়েন্টে আন্দোলনে মারধর


তারিখ বেঁধে দেয়া হয় ১০ নভেম্বর। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এই লড়াকু সৈনিক হিসেবে তিনি রাজপথে নেমে এসেছিলেন। তার বুকে পিঠে লেখা ছিল ’গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ শ্লোগান। কিন্তু গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার এই যুবকের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল এরশাদ স্বৈরাচারের বন্দুক। স্বৈরাচারের বুলেট বুকে বরণ করে নিয়েছিলেন নূর হোসেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে নূর হোসেন একটি অবিস্মরণীয় নাম। আর সে-ই দিবসটিতেই সম্প্রতি ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা সরকার বেছে নেয় এবার। কেননা ওইদিন ছিল নূর হোসেন দিবস। আর ওই দিবসেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মিছিল করতে বলা হয়। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শেখ হাসিনার নিদের্শেই জানিয়ে দেয়া হয় যে, মিছিলে নেতাকর্মীদের হাতে যেনো রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি থাকে। উদ্দেশ্য ছিল এধরনের কর্মসূচিতে যদি কেউ যদি বাধা দেয়, কোনো হামলা করে তাহলেও বিরাট লাভ। তাহলে তো সেটা-কে ধরে নেয়া হবে ট্রাম্পের ছবিতে হামলা হয়েছে। আর এধরনের ছবি তোলার জন্য কাজেও আলাদা লোক থাকবে। তখন সেই হামলার ছবি ট্রাম্পের কাছে পাঠানো হবে। কেননা। ট্রাাম্পের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে শেখ হাসিনার।

শেখ হাসিনার নতুন একটি অডিও ফাঁসে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেশের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় তাকে। সেখানে ছুড়ে দেন নানা হুমকিও। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) শেখ হাসিনার ‘কণ্ঠে’ নতুন একটি ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই ফোনালাপে শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি হাতে মিছিল বের করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অডিওতে বলা হয়, মিছিলে তাদের হাতে ট্রাম্পের ছবি থাকবে। এতে যদি কেউ যদি বাধা দেয়, কোনো হামলা করে। তাহলে তো সেটা ট্রাম্পের ছবিতে হামলা হবে। সেই ছবি তোলার জন্য আলাদা লোক থাকবে। তখন সেই হামলার ছবি আমি ট্রাম্পের কাছে পাঠাব। ট্রাম্পের সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ আছে। এই অডিওতইে শেখ হাসিনা জানান, বাধা দেওয়ার ছবি ট্রাম্পকে পাঠিয়ে বলা যাবে দেখো ইউনূস সরকার কী করছে। সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার তো ইউনূস। ২৫০ জন এসআইয়ের (ক্যাডেট সাব-ইন্সপেক্টর) চাকরি দিল না, তাদের বের করে দিল। তিনি আরও বলেন, মিছিলে ভালো লোক জমায়েত যেন হয়, সে ব্যবস্থা করবা। মিছিলে নূর হোসেনের ছবি থাকবে। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা প্লেকার্ড রাখবা। আমাদের অনেক ঘরবাড়ি, দোকান-পাট পোড়ানো হয়েছে। এর তথ্য বের করতে হবে। আমরা সব হিসাব কড়ায়-গন্ডায় করে নেবো। 

শুরু হয় প্রতিবাদ প্রতিরোধ

আর পায় কই। একদিকে বিএনপি, অন্যদিকে ছাত্র-জনতার ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা নেমে পড়ে দিবসটিতে। অন্যদিকে শহীদ নূর হোসেন স্মরণে ও ‘অগণতান্ত্রিক শক্তির অপসারণ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ প্রায় তিন মাস পর প্রকাশ্যে রাজধানীতে রাজনৈতিক কর্মসূচির পালনের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্বরে কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। কিন্তু এদিকে একইস্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে গণজমায়েতের ডাক দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এছাড়া আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে আগের দিন রাত থেকে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয় ছাত্র জনতা। সকাল থেকে গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে নেয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। সেখানে সাঁজোয়া যান ও জলকামানের গাড়ি নিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকে পুলিশ সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও এ বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, গণহত্যাকারী ও নিষিদ্ধ সংগঠনের কেউ কর্মসূচি করার চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে তিনি আরও লেখেন, আওয়ামী লীগ তার বর্তমান রূপে একটি ফ্যাসিবাদী দল। গণহত্যাকারী ও স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নির্দেশ নিয়ে যে কেউ র‌্যালি, সমাবেশ ও মিছিল করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ শক্তির মুখোমুখি হবে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে মারধর-বাধা

এদিবে স্বৈরাচারী হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতিহতের ঘোষণা আগেই দেওয়া ছিল। গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় ১০ নভেম্বর শনিবার দিবাগত রাত থেকেই ছাত্র-জনতার দখলে ছিল গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টের শহীদ নূর হোসেন চত্বর। কিন্তু এরই মধ্যে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোন দিয়ে শহীদ নূর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। ২০-২৫ জনকে পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি ব্যবহার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল করায় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নব্বইয়ের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ নূর হোসেন এই দিনে মারা যান। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল শহীদ নূর হোসেন দিবসটি পালন করে আসছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অন্তত ২০ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে মারধর করে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্র-জনতা। এ সময় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নূর হোসেন চত্বরে আসার চেষ্টা করে। প্রথমে দুজন নারীকে আওয়ামী লীগের কর্মী সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পরে তাদের পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়। পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী নাছিরুল আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কিছু লোক আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়েছিল। ছাত্র-জনতা তাদের ধরে পুলিশের কাছে হস্তাান্তর করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়েছে। অন্যদিকে অইদিন সাকেল দু’জন নারীকে আওয়ামী লীগ কর্মী সন্দেহে হেনস্তা করা হয়। পরে তাদের পুলিশে তুলে দেওয়া হয়। ওই দুই নারীর পরিচয় জানা যায়নি। দুপুর ১২টার দিকে এক বৃদ্ধ আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে এসে হঠাৎ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘দেশে দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে গেছে। দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যাওয়ার পর দেশ শেষ হয়ে গেছে। ইনশাল্লাাহ, শেখ হাসিনা চলে আসবেন। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা- একথা বলছি।’ এ সময় সেখানে অবস্থান করা বিএনপি-যুবদলসহ ছাত্র-জনতা তাকে পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। তবে গণপিটুনির সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই বৃদ্ধকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। এ ছাড়াও সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যাকেই সন্দেহ হয়েছে, তার ফোন চেক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক-কর্মী সন্দেহ হলেই গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। পরে পুলিশে তুলে দেওয়া হয়েছে। জিরো পয়েন্টে আসা কমপক্ষে ২০-২৫ জন কর্মী-সমর্থককে মারপিট করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপের নির্দেশনা বাস্তবায়নকারীসহ ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

হলো মামলা.. ফল হলো উল্টো..

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথিত একটি অডিও ক্লিপের নির্দেশনা বাস্তবায়নকারী ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে ফেলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অভিযোগে বলা হয় তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে মিছিলে ভাঙচুর ও অবমাননার পরিকল্পনা করছিলেন। শনিবার (১০ নভেম্বর) দিবাগত রাতে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমকে তিনি জানান, সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এক অডিও বার্তায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে মিছিল সমাবেশ আয়োজন করেন। সেই ছবি ও প্ল্যাকার্ডগুলিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি এগুলোর ভাঙচুর ও অবমাননার ফুটেজ সংগ্রহের নির্দেশও দেন তিনি। ডিএমপি কর্মকর্তা গণমাধ্যমে আরও জানান, এই অপতৎপরতার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক নষ্ট করা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ৯ নভেম্বর শনিবার রাতে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ উসকানিমূলক পোস্টার, ছবি, প্ল্যাকার্ড এবং নগদ অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে। এধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফাঁস হওয়া অডিও তে আওয়ামী লীগ যেভাবে কর্মসূচিতে পালন করে দেশে বিদেশে ফায়দা নিতে চেয়েছিল কার্যত তা হয়নি। কারণ ওই ফোনালাপে শেখ হাসিনা দলীয় নেতাকর্মীদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি হাতে মিছিল বের করার পরামর্শ দেন। বলেছিলেন নূর হোসেন দিবসে নেতাকর্মীদের মিছিল করতে। বলেছিলেন, সেই মিছিলে তাদের হাতে ট্রাম্পের ছবি থাকবে। এতে যদি কেউ যদি বাধা দেয়, কোনো হামলা করে। তাহলে তো সেটা ট্রাম্পের ছবিতে হামলা হবে। সেই ছবি তোলার জন্য আলাদা লোক থাকবে। তখন সেই হামলার ছবি তিনি ট্রাম্পের কাছে পাঠাবেন। কিন্তু কার্যত সেধরণের ঘটনার আগেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে উল্টো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে মিছিলে ভাঙচুর ও অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। বলা হয় অপতৎপরতার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক নষ্ট করা। ফলে আসলে শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্যে এমন কর্মসূচি দিয়েছিল তা ভেস্তেই যায়। তার এমন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে উল্টো কেবল মামলা মোকাদ্দমায় পড়েনি, বরং আওয়ামী লীড়ের ঘাড়েই আমেরিকাকে অসন্মান করার দোষ পড়ে যায়। উল্টো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ব্যবহার করে মিছিলে ভাঙচুর ও অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা পড়ে যায় তারা। পাশাপাশি এমন অবিবেচকসূলভ কর্মসূচির জন্য আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে ভৎর্সনা করতে দেথা যায় অনেককে।

শেয়ার করুন