নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বাড়িতে গত ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার এফবিআই এজেন্টরা অভিযান চালিয়েছে। এফবিআই এজেন্টরা এই অভিযানের সময় প্রথম ডেপুটি-মেয়র শীনা রাইট, জননিরাপত্তার ডেপুটি মেয়র ফিলিপ ব্যাঙ্কস, নিউইয়র্ক সিটি স্কুলের চ্যান্সেলর ডেভিড ব্যাঙ্কস এবং মেয়রের উপদেষ্টা টিমোথি পিয়ারসনের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে এবং বিভিন্ন ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি নিউইয়র্ক পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার কাছ থেকেও ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করেছে। অভিযানের মধ্যে নিউইয়র্ক সিটি পুলিশের কমিশনার এডওয়ার্ড কাবানের বাড়িতেও অভিযান চালানো হয় এবং ডিভাইসগুলো জব্দ করা হয়। ফেডারেল এজেন্টরা বুধবার সকালে প্রথম ডেপুটি মেয়র শীনা রাইটের ম্যানহাটনের হ্যামিলটন হাইটসের টাউনহাউজে এবং জননিরাপত্তার ডেপুটি মেয়র ফিলিপ ব্যাঙ্কসের কুইন্সের হোলিসের বাড়িতে হানা দেন। ফেডারেল এজেন্টরা রাইট ও ব্যাঙ্কসের ফোন এবং ল্যাপটপ জব্দ করেছেন। এছাড়া মেয়রের উপদেষ্টা টিমোথি পিয়ারসনের বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়েছে। টিমোথি পিয়ারসন একজন প্রাক্তন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে নিউইয়র্ক পুলিশ কমিশনার এডওয়ার্ড কাবানের বাড়ি থেকেও কিছু ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে। তবে এটি পরিষ্কার নয় যে, কাবানের বাড়িতে চালানো অভিযান অ্যাডামস প্রশাসনের অন্য অভিযানের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না। এই অভিযানের বিষয়ে এখনো কোনো অভিযোগ ওঠেনি। মেয়র এরিক অ্যাডামস ৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমাদের প্রশাসন সব সময় আইন মেনে চলে এবং সে পথেই আমরা থাকবো। যদিও অভিযানের উদ্দেশ্য এখনো অজানা, তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।’
২০১৪ সালে ফিলিপ ব্যাঙ্কস নিউইয়র্ক পুলিশের প্রধান পদ থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করেন। তখন তার বিরুদ্ধে ফেডারেল তদন্ত চলছিল, যেখানে অভিযোগ করা হয়েছিল যে তিনি ঘুষ হিসেবে হাজার হাজার ডলারের বিনিময়ে খাবার এবং ক্রীড়া টিকেট গ্রহণ করেছিলেন। গত বছর নভেম্বর মাসে ফেডারেল এজেন্টরা মেয়র এরিক অ্যাডামসের প্রধান প্রচারাভিযান তহবিল সংগ্রাহক ব্রায়ানা সাগসের ব্রুকলিনের ক্রাউন হাইটস এলাকায় অবস্থিত বাড়িতে অভিযান চালায়। সে সময় অ্যাডামস ও তার প্রচারাভিযান দল একাধিকবার নিয়ন্ত্রকদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ৩ লাখ ডলারের বেশি তহবিলের উৎস গোপন করেন। সাগসের বাড়িতে অভিযান চালানোর কয়েকদিন পর ফেডারেল এজেন্টরা অন্তত দুটি ফোন এবং একটি আইপ্যাড জব্দ করেন যা মেয়র অ্যাডামসের ছিল। নিউইয়র্ক টাইমস অনুসারে, ওই তদন্তটি মূলত অ্যাডামসের ২০২১ সালের মেয়র পদপ্রার্থিতার প্রচারণা তুর্কি সরকার ও অন্যদের কাছ থেকে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়ে কেন্দ্র করে ছিল।
মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অ্যাডামস তার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের শীর্ষপদে নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ডেভিড ব্যাঙ্কস, যাকে পাবলিক স্কুলের চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এবং শীনা রাইট, যাকে ডেপুটি মেয়র হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অ্যাডামসের দীর্ঘদিনের বন্ধু লিসা হোয়াইটকেও নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ডেপুটি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে তার বার্ষিক বেতন ২ লাখ ৪১ হাজার ডলারের বেশি।
মেয়র অ্যাডামসের প্রশাসন বিভিন্ন ইস্যুতে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। গত জুলাই মাসে নিউইয়র্ক সিটির কারাগারে সোলিটারি কনফাইনমেন্ট নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবটি অ্যাডামস অবরোধ করেছিলেন, যার ফলে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে কমপক্ষে ২৬ জন মারা গেছেন। সিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র শার্লি লিমঙ্গি এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিদিন মেয়র অ্যাডামসের প্রশাসন দেখাচ্ছে যে তারা আইন এবং গণতন্ত্রকে কতটা অমর্যাদা করে। তার মতে, প্রশাসন দ্বিমুখী মানদণ্ড প্রয়োগ করছে, যা নিউইয়র্কের নাগরিকদের ক্ষতির মুখে ফেলছে। এসব ঘটনাবলির মধ্যে, ফেডারেল এজেন্টদের সাম্প্রতিক অভিযানের পর অ্যাডামস প্রশাসনের প্রতি নতুন প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছে।
এরিক অ্যাডামসের প্রশাসনের সদস্যদের ওপর ফেডারেল এজেন্টদের অভিযান এখন একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। এই সপ্তাহে, পাবলিক সেফটির ডেপুটি মেয়র ফিল ব্যাংকসের বাড়িতে ফেডরা অভিযান চালায় বলে জানা গেছে। বুধবার সকালের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বাড়িতে অভিযানগুলো নিউইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট দ্বারা পরিচালিত একটি নতুন তদন্তের অংশ। এটি আগের প্রচারাভিযানের আর্থিক দুর্নীতির তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যদিও আগের প্রচারাভিযানের আর্থিক তদন্তের পুরো বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট, এটি অন্তত আংশিকভাবে ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনের সময় অ্যাডামসের প্রচারাভিযান তুরস্কের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ বিদেশি অনুদান পাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে শিনা এবং নিউইয়র্ক সিটি ফায়ার ডিপার্টমেন্টকে নিরাপত্তা উদ্বেগ সত্ত্বেও ম্যানহাটনে তুরস্কের নতুন কনস্যুলেটের অনুমোদন দ্রুত দিতে চাপ দিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে। এছাড়াও এই তদন্তে তুর্কিশ এয়ারলাইনসের কাছ থেকে মেয়র যে মূল্যবান ফ্লাইট আপগ্রেড পেয়েছেন তা নিয়ে তদন্ত চলছে।
একই সময়ে, নিউইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট উইনি গ্রেকো নামে অ্যাডামসের এক সহকারীকে স্ট্রো ডোনার স্কিমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত করছে।
অ্যাডামসের বিরুদ্ধে এখনও কোনো অন্যায় কাজের অভিযোগ আনা হয়নি। তিনি ক্রমাগত দাবি করেছেন যে তিনি এই তদন্তে সহযোগিতা করছেন এবং কোনো আইন ভঙ্গ করেননি। সিটি হলের চিফ কাউন্সেল লিসা জর্নবার্গ এক বিবৃতিতে বলেন, তদন্তকারীরা আমাদের জানায়নি যে মেয়র বা তার কর্মীরা কোন তদন্তের লক্ষ্যবস্তু। একজন প্রাক্তন আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হিসাবে, মেয়র বারবার স্পষ্ট করেছেন যে দলের সব সদস্যকে আইনের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।’
নিম্নে অ্যাডামস প্রশাসনের এবং তার প্রচারাভিযানের তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো তুলে ধরা হলো। এই ঘটনাগুলো এখনো বিকাশমান।
২ নভেম্বর ২০২৩ :
এফবিআই এজেন্টরা অ্যাডামসের ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনের তহবিল সংগ্রহকারী ব্রিয়ানা সাগসের বাড়িতে ভোরবেলা অভিযান চালায়। এই অভিযানে বেশ কয়েকটি ডিভাইস এবং নথি জব্দ করা হয়। সেদিন মেয়র নিউইয়র্ক সিটিতে অভিবাসীদের আগমন নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনের পথে ছিলেন, কিন্তু তিনি তার বৈঠক বাতিল করে সিটিতে ফিরে আসেন। নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, সেদিন তুরস্কের সঙ্গে সংযুক্ত দুই ব্যক্তির বাড়িতেও আলাদা দল অভিযান চালায়-একজন হলেন রানা আব্বাসোভা, অ্যাডামসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দফতরের এক সহকারী এবং অপরজন চেঙ্ক ওকাল, তুর্কিশ এয়ারলাইনসের সাবেক এক্সিকিউটিভ এবং অ্যাডামসের ট্রানজিশন টিমের সদস্য।
৬ নভেম্বর ২০২৩ :
এফবিআই এজেন্টরা ম্যানহাটনে একটি ইভেন্টে অংশ নেওয়ার পরে অ্যাডামসের ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দ করে। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যেখানে তারা অ্যাডামসের নিরাপত্তা কর্মীদের দূরে সরিয়ে মেয়রের গাড়িতে গিয়ে এই ডিভাইসগুলো জব্দ করে। জব্দ করার কয়েক দিনের মধ্যে ডিভাইসগুলো তাকে ফেরত দেওয়া হয়। অ্যাডামস এবং তার প্রচারাভিযানের প্রতিনিধিত্বকারী একজন আইনজীবী জানান যে মেয়র ফেডারেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন এবং তিনি ইতোমধ্যে এমন একজন ব্যক্তির বিষয়ে ‘স্বেচ্ছায় রিপোর্ট’ করেছেন, যিনি ‘সম্প্রতি অনুপযুক্ত আচরণ করেছিলেন।’
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ :
এফবিআই এজেন্টরা লিপ ডে অভিযানে অ্যাডামসের সহকারী উইনি গ্রেকোর ব্রঙ্কসে দুটি বাড়ি এবং কুইন্সের ফ্লাশিংয়ে নিউ ওয়ার্ল্ড মলে অভিযান চালায়। ধারণা করা হচ্ছে, এই তদন্তটি নিউইয়র্কের ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট পরিচালনা করছে।
জুলাই ২০২৪ :
এফবিআই এজেন্টরা অ্যাডামস এবং তার ২০২১ সালের মেয়র নির্বাচনী কমিটি জুলাই মাসে নতুন ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি সমন পায়। এই সমনগুলিতে টেক্সট মেসেজ, অন্যান্য যোগাযোগের উপকরণ এবং নথি চাওয়া হয়। নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, এই সমনগুলো তুরস্ক তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত।
৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪:
এফবিআই এজেন্টরা ভোরবেলা প্রথম ডেপুটি মেয়র শিনা রাইট এবং স্কুল চ্যান্সেলর ডেভিড ব্যাংকসের (যারা একসঙ্গে থাকেন) এবং পাবলিক সেফটির ডেপুটি মেয়র ফিল ব্যাংকসের বাড়িতে অভিযান চালায়। এজেন্টরা কর্মকর্তাদের ডিভাইসগুলো জব্দ করে। নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, এই অভিযানগুলো মেয়রের প্রচারাভিযানের তুরস্ক দুর্নীতি তদন্তের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তবে সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কর্তৃক পরিচালিত আরও একটি তদন্তের অংশ।
নিউইয়র্ক ওয়ান জানায়, পুলিশ কমিশনার এডওয়ার্ড কাবান এবং অ্যাডামসের শীর্ষ সহকারী টিম পিয়ারসনের বাড়িতেও অভিযান চালানো হয়। নিউইয়র্ক পোস্ট জানায়, এই অভিযানগুলিতে ফিল এবং ডেভিড ব্যাংকসের ভাই টেরেন্স ব্যাংকস এবং এডওয়ার্ড কাবানের ভাই জেমস কাবানের বাড়িও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এনওয়াইপিডির ক্ষেত্রেও অভিযানটি চালানো হয়েছিল, যেখানে এনওয়াইপিডি চিফ অফ স্টাফ রাউল পিন্টোস এবং ম্যানহাটন ও কুইন্সের দুটি প্রিসিঙ্কটের কমান্ডারদের ফোনও জব্দ করা হয়।