৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪১:১৫ অপরাহ্ন


তিন কারণে বিএনপির বেপরোয়ারা নিয়ন্ত্রণে আসছে না
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৭-২০২৫
তিন কারণে বিএনপির বেপরোয়ারা নিয়ন্ত্রণে আসছে না বিএনপির দলীয় পতাকা


বিএনপিতে এক শ্রেণীর নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে চাঁদাবাজি,দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের পাশাপাশি দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপ বেড়েই চলেছে। এসব বন্ধে হাইকমান্ডের নির্দেশসহ নানান ধরনের কঠোর পদক্ষেপের পরও এর লাগাম টেনে ধরা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বরং ইদানিং এর মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। দিনের পর দিন বেড়ে চলায় দলের ইমেজ দেশে- বিদেশে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করে বিশ্লেষকরা মনে করেন, তিন কারণে দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপের মাত্রা বেড়ে চলেছে। 

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে কারো কারো মতে, দুই প্রধান ব্যক্তির লন্ডন বৈঠক চলমান পরিস্থিতিতে একটি ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করছে। সম্প্রতি লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে দু-ই প্রধান ব্যক্তির ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক। ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। কারো কারো মতে, এমন বৈঠকটি বাহিরের চেয়ে দলের ভেতরে প্রচন্ডরকম যেমন আস্থা তৈরি হয়েছে, তেমনি একটা অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি বড়ো অংশ ধরেই নিয়েছে যে তারা আগামীতে ক্ষমতায় আসছে। রাজসিংহাসন তাদেরই। এখনো তারিখ ঘোষণা করা না হলেও বিএনপি’র একশ্রেণীর নেতাকর্মী লন্ডন বৈঠককে একটি সম্মানজনক সাফল্য হিসাবে উপস্থাপিত না করে ক্ষমতার দাপট দেখানোর কাছে ব্যস্ত। দেশের জনগণের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি না করে বরং একশ্রেণীর নেতাকর্মী বরং চাঁদাবাজি ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। 

প্রশাসন দোটানায়

বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি অংশের পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে দেশের ‘বর্তমান প্রশাসনের একটি বড়ো অংশে বড়ো ধরনের আস্থার সঙ্কট বিরাজ করছে। প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী বুঝতেই পারছে না যে তারা আসলে কোন পক্ষে যাবে। বিশেষ করে আইন শৃংখলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে অতিমাত্রায় ব্যবহার হওয়ার কারণে তাদের গ্রহযোগ্যতা কিংবা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারার ক্ষমতায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। এব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, আইনশৃংখলা বাহিনীর মধ্যে বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী মাঠে দুইটি চাপে আছে। একদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজে গড়ে উঠা জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে মাঠে যেমন চাপ অনুভব করছেন, তেমনি বিএনপি থেকেও। মাঠ পর্যায়ে তারা যেকেনো পদক্ষেপ নিতেই দোটনায় পড়ে যায়। যেহেতু অতীতে এই বাহিনীর একটি বড়ো অংশই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের ইমেজ নষ্ট করেছে তাই এখন যে অরাজনৈতিক মাঠে শক্ত অবস্থান নিতে গিয়ে নানান ধরনের ঝক্কি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। আর এতে করে মাঠে বড়ো রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি বাড়তি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আর এসুযোগে যা ইচ্ছা তারা তা করে যাচ্ছে দলের কোনো কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। তারা কোনো কিছুতেই তোয়াক্কা-ই করছে না..

ব্যবস্থা গ্রহণকে সাময়িক বলে ধরে নিচ্ছে

বিএনপির নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিংবা অসদাচরণ করলে কেউ রেহাই পাবে না বলে কঠোর বার্তা দিয়েই যাচ্ছে একেবারে শীর্ষ থেকে, প্রচার করা হচ্ছে অহিংস অবস্থানের কথা। সর্বশেষ বেশ কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবারও কঠোর বার্তা দেওয়া হয়। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের এ অবস্থানের কথা জানান। রিজভী বলেন, ‘স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, দলের নামে যে কেউ যে কোনো ধরনের অনৈতিক, অবৈধ, সন্ত্রাসী, সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড করলে রেহাই পাবে না। আমরা তাৎক্ষণিক তদন্ত এবং ভিডিও-অডিও সবকিছু পরীক্ষা করব। যদি দেখা যায় কেউ দায়ী, তাঁর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, দেশে কোথায় কী ঘটছে, কারা কী করছে- খবর পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 

কিন্তু থামছে না কেনো

ওই সংবাদ সম্মেলনে রিজভী জানান, ইতোমধ্যে বিএনপির এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ৪-৫ হাজার বিএনপি নেতাকর্মী, যারা দলের নামে, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নামে, সহযোগী সংগঠনের নামে দুর্বৃত্ত চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে অথবা দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তুলেছিল, অনৈতিক কাজের মধ্যে ছিল, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে। তিনি দাবি করেন এক্ষেত্রে বিএনপি এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একেবারে জিরো টলারেন্স নীতিতে আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এরপরেও থামানো যাচ্ছে না কোনো? এব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, দলের নামে, বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের নামে দুর্বৃত্ত চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে অথবা দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তোলাদের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থাকে তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। তাদের অনেকেই মনে করছেন যে দল এখন যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে তা হবে খুবই সাময়িক। আর তাছাড়া দল এখনো ক্ষমতায় আসেনি। ফলে দলের কেউ এসব অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও ফ্যাসিবাদী সরকারের রেখে যাওয়া প্রশাসন কিছুই করতে পারবে না। আবার আরেকটি অংশ মনে করে যে, যাদের বিরুদ্ধে দল এখন ব্যবস্থা নিচ্ছে, ঠিক নির্বাচন কিংবা দল ক্ষমতায় বসার সাথে সাথে সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। কেননা দলের কারো কাছেই এব্যাপাারে অতীতের অপকর্মের কোনো তথ্যই থাকবে না। এসব ভেবেই বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। 

শেষ কথা

সম্প্রতি রাজধানীর মহাখালীর রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে যুবদল নেতা মনির হোসেনের বিরুদ্ধে। বার কর্তৃপক্ষ বলছে, ভিআইপি রুম না দেওয়ায় অনুসারীদের নিয়ে এসে তান্ডব চালায় মনির। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একই দিনে ফরিদপুরে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদের বাড়িতে চড়াও হয়েছেন স্থানীয় বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা। ‘আওয়ামী লীগের গোপন মিটিং’ হচ্ছে- দুয়ো তুলে এই ঘটনা ঘটানো হয়। শহরের ঝিলটুলীতে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গণমাধ্যমের খবরে এসেছে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থানা ঘেরাও করে ছাত্রদল কর্মীকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অভিযোগ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আবার দেখা গেলো রাজশাহী মহানগর বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনের একটি কক্ষ দখলের অভিযোগ। বিএনপি’র প্রকৃত শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন, একের পর এক এধরনের বিষয়গুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে দলটির জন্য। কেননা অহিংস নীতি অবলম্বনের ব্যাপারে যেখানে খোদ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একেবারে জিরো টলারেন্স নীতিতে আছেন তখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বাস্তাবেই দলে এতো অতি উৎসাহী আসলে কারা? এরা কি কারো পক্ষ নিয়ে একটি পরিস্থিতি তৈরি চাচ্ছে? এমন প্রশ্নই সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। 

শেয়ার করুন