৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:২৩:০৭ অপরাহ্ন


রাজনীতির নামে জামায়াতের ধান্ধাবাজি!
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০১-২০২৫
রাজনীতির নামে জামায়াতের ধান্ধাবাজি! বক্তব্য রাখছেন রুহুল কবীর রিজভী


একরকম নাম না উচ্চারণ করে জামায়াত ইসলামকে ধুয়ে দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকেই জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বিএনপির নাম না উচ্চারণ করে একের পর এক বক্তব্য দেন বিভিন্ন মহলে। যা ফলাও করে প্রকাশিতও হয়। বিশেষ করে বিএনপি একটি ‘চাঁদাবাজ দল’ এটাই এস্টাব্লিশ করার চেষ্টা করা হচ্ছে ৫ আগস্টের পর থেকে। এ ব্যাপারে বিএনপি তেমন মুখ না খুলে আমলে না নিলেও এ অভিযোগ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকার পর, বিএনপি এবার জবাব দিতে শুরু করেছে। গত ২৯ ডিসেম্বর তারই অংশ হিসেবে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নাম না উল্লেখ করে যে সব কথা বলেছেন তার সবটাই যে জামায়াত ইসলামীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তা আর বুঝতে বাকি নেই কারোই। রোববার সকালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণের পরে সাংবাদিকদের কাছে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব অভিযোগ করে বলেন, ৫ আগস্টের পর মানুষ দেখলো, আমরা দেখলাম একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা একটি ইসলামী ব্যাংক দখল করে নিয়েছে।

রিজভী তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে জুলাই-আগস্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, অনেকেই অনেক কথা বলছেন। অনেকজনে নানাভাবে শুধু কয়েকজনের কৃতিত্বের কথাই বলেন। কিন্তু তারা কি শহীদ শ্রমিক ভাই, রিক্সা চালকদের বাসায় গিয়েছিলেন? তাদের পরিবার, তাদের সন্তানেরা কেমন আছে? তাদের পরিবার দু’মুঠো খেতে পারছে কি না। কারণ উপার্জনের তো একজনই ব্যাক্তি। সে তো নেই, পৃথিবী থেকে চলে গেছে। তার সন্তানেরা স্কুলে যাচ্ছে কি না, এটা খবর আমরা কয়জনে নিয়েছি। 

বন্ধুরা আমার, ১৫ বছর ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন এ আন্দোলন। এ আন্দোলনে তো জাতীয়তাবাদী শক্তির অনেকে নেই। ওরা কোথায় গিয়েছে। কোনো প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছে। হাসিনা তো ওদের নিরুদ্দেশ করেছে। কোথায় জাকির, শোভন, কোথায় ইলিয়াস আলী, কোথায় চৌধুরী আলম। কোথায় সাইফুল ইসলাম হিরু, কোথায় হুমায়ুন পারভেজ। এদের যে অবদান তারা তো জাতিকে অগ্নিগর্ভা করে তুলেছিল। আর তারই পরিণতি জুলাই-আগস্টে হয়েছে। সেখানেও যারা জাতীয়তাবাদী শক্তির সমার্থক, বিএনপির সমার্থক, এরকম ৯৭ জন মানুষ আজকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এরা গণতন্ত্রের জন্য শহিদ। আজকে কয়জন এদের কথা বলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তার উপদেষ্টামন্ডলী, কয়জন তাদের স্মরণ করেছে। তারা সরকার গঠন করেছে, উপদেষ্টাও হয়েছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই মাঝে মাঝে সবক দেয়। 

তিনি বলেন, আবার দু-একটি রাজনৈতিক দল দেখি তারাও সবক দেন যে, চাঁদাবাজ বিদায় নিয়েছে আর কোনো চাঁদাবাজকে আমরা দেখতে চাই না। আর চাঁদাবাজ না আসুক। তিনি বলেন, কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন? শেখ হাসিনার আমলে যারা ব্যাংক লুট করেছে, ব্যাংক আত্মসাৎ করেছে.. এস আলমদের উত্তরসূরি হিসেবে ৫ আগস্টের পর আমরা কি ব্যাংক আত্মসাৎ করতে দেখিনি? আমরা তো দেখেছি, ইসলামী ব্যাংক কীভাবে গ্রাস করে নিলো একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা। 

ইসলামী ব্যাংক দখলকারী অনুসারীদের দলের না উল্লেখ না করে রিজভী বলেন, তাহলে আজকে কোন মুখে বলছেন, এক চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেক চাঁদাবাজকে দেখতে চাই না.. কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন আমরা বুঝি না। আমরা তো প্রথমেই দেখলাম ৫ আগস্টের পরেরদিনই ইসলামী ব্যাংক আপনারা দখল করে নিয়েছেন। এটা কি জনগণ দেখেনি। এটা তো জনগণ দেখেছে। আজ বড় বড় কথা বলেন, কলঙ্ক লেপন করার চেষ্টা করেন বিএনপির নামে। পাড়া-মহল্লায় জেলায় জেলায় অনেক টার্মিনাল, সিএনজি স্ট্যান্ড দখলসহ অনেক টেন্ডার ভাগাভাগির সঙ্গে আপনাদের লোকেরা কি জড়িত নেই। আমি সেই রাজনৈতিক দলটিকে বলতে চাই, খুব নীরবে নিভৃতে সব অপকর্মের সঙ্গে আপনারা জড়িত। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ব্যাংক আত্মসাৎ তো জনগণ দেখেছে।

রিজভী বলেন, আমরা হাসিনার আমলে দেখেছি, চাপাতি লীগ, হেলমেট লীগ, বন্দুক লীগ। আবার জনগণ এটাও জানে, ক্ষুর পার্টি, পায়ের রগকাটা পার্টি এরা কারা জনগণ জানে না? কারা পায়ের রগ কাটে এদেরকে জনগণ চিনে, জানে।

তিনি বলেন, সুতরাং আমরা বুঝি আপনারা খুব ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছেন। আপনাদের ৭১-এর অর্জন কী। আপনারা একাত্তরের বিরোধিতা করেছেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন, এ গৌরব বিএনপির। ৭১-এর, ৯০-এর গৌরব বিএনপির। কারণ ৯০-এ আপনারা শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করে এরশাদের মতো একটা স্বৈরাচারের সঙ্গে আপনারা গিয়েছিলেন, ১৯৮৬ সালে এরশাদ কুলাঙ্গারের নির্বাচনে আপনারা যাননি? এটাও জনগণ দেখেছে। 

তিনি বলেন, বিএনপি ৮৬ সালের সেই নির্বাচনে যায়নি। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচন করবো না, স্বৈরাচারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবো না। সে সময় মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য এসেছিল। ভয়ানক হাসিনার স্বৈরাচার কায়েম করার জন্য এসেছিল। তখনও আপনারা বাধ্য করেছিলেন তার নির্বাচনে যেতে। এটাও জনগণ দেখেছে, জনগণ জানে। 

রিজভী বলেন, ‘আপনারা তো ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন। ইসলাম মানে কী বারবার মোনাফেকি করা? ইসলামের বাণী হলো, তুমি যে অঙ্গীকার করো, সে অঙ্গীকার রক্ষা করবে। এটাই তো ইসলামের মর্মবাণী। বন্ধুগণ, বিএনপি সে ঐতিহ্যের পতাকা ধারণ করে, যে ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে বিএনপি, যে অঙ্গীকার করে সে অঙ্গীকার থেকে বিন্দুমাত্র পশ্চাৎপদ অনুসরণ করে না। এ গৌরব বিএনপির, এ গৌরব জিয়াউর রহমানের, এ গৌরব দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার, এ গৌরব তারেক রহমানের। তাই বন্ধুগণ, ৭১ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গলতন্ত্রের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র মাথা নত করেনি বিএনপি।’

কিন্তু (জামায়াতকে উদ্দেশ্য করে) আপনারা ৫ আগস্টের পর কী বললেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক উন্নয়ন করবো। আপনারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনাদের নেতা না মাওলানা সাঈদী সাহেব। সে সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্য সুখরঞ্জন বালীকে ধরে নিয়ে তার শরীরে ইলেকট্র্রিক শক দিয়েছে। তার সব বয়ান এসেছে। সুখরঞ্জন বালী হিন্দুধর্মের একজন মানুষ। তাকে শেখ হাসিনার গোয়েন্দা বাহিনী বলেছে, তোমরা বলো, তোমার ভাইকে হত্যা করিয়েছে মাওলানা সাঈদী সাব। কিন্তু সুখরঞ্জন বলেছে, আমি মিথ্যা সাক্ষী দেবো না। সে সেটা করেনি। সুখরঞ্জন বালী হিন্দুধর্মের একজন মানুষ। যে সাহসিকতা, যে ন্যায়নীতি দেখিয়েছে, সেটা আমি ওই রাজনৈতিক দলের বন্ধুদের আমি বলতে চাই, আপনারা শিখুন তার কাছ থেকে। আপনারা সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চান ভারতের সঙ্গে, শেখ হাসিনার প্রতিটি গুম-খুনের দোসর হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ (ভারত), এ সুখরঞ্জন বালীকে হাইকোর্টের গেট থেকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে, তাকে টর্চার করে, তাকে টাকার অফার দেওয়ার পর, সে যখন মাথা নোয়ায়নি, তখন তাকে ভারতে পাচার করে দিয়েছে এবং ভারতের কারাগারে সে পাঁচ বছর ছিল। সে পাঁচ বছর পর সেখান থেকে সে মুক্তি পেয়ে এসে এসব কথা এখন বলছে।’

রিজভী বলেন, এরপরও আপনারা বলবেন, ‘শেখ হাসিনার সব মাফ করে দেবেন? এখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করবেন এর মধ্য দিয়ে মনে হয় আপনারা ন্যায়নীতির পরোয়া করেন না। আপনারা রাজনীতির নামে ধান্ধাবাজি করেন। আপনারা অন্য কিছু করেন না। আপনার দলের প্রধান নেতাদের যারা জুডিশিয়াল প্রক্রিয়ার নামে জুডিশিয়াল কিলিং করলো-তাদের বলছেন আপনারা মাফ করে দেবেন। তাহলে আপনারা ইসলামের যে মর্মবাণী, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করো, প্রতিরোধ করো, সেটি আমাদের (আপনাদের) মধ্যে নেই। করুণা করার কথাও বলা হয়েছে। যে ক্ষমা চাইবে তাকে করুণা করতে বলা হয়েছে। সেটারও বিভিন্ন ধাপ আছে। ওরা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমা চাইলো না, আপনারা ক্ষমা করে দেবেন, সম্পর্ক উন্নয়ন করবেন, আপনারা আপনাদের রক্তের সঙ্গেই বেইমানি হলো না?’ রিজভী বলেন, ‘যেমন ৮৬ সালে আপনারা বলেছিলেন আপনারা নির্বাচনে যাবেন না, তারপরও আপানারা গিয়েছিলেন।’

রিজভি বলেন, ‘বন্ধুগণ, এ ধরনের অপপ্রচার। আজকে শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ, শুধু তারাই অপপ্রচার, কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করছে না, ভেতর থেকেও অনেকেই আমি আগেই বলেছি যতই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের যে গণতন্ত্রে এতো অবদান, এতো আত্মদান, এতো মানুষ নিরুদ্দেশ (গুম), বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার, আজকে তো সব গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক শক্তির একস্থানে থাকার কথা, অথচ এই শক্তিকে ফাটল ধরিয়ে দু-একটি রাজনৈতিক দল যেভাবে ফায়দা তোলার চেষ্টা করছেন, এ দেশের মানুষ সব জানে, কারা দেশপ্রেমিক, কারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, কারা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে, কারা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, কাদের ঐতিহ্যের মধ্যে জড়িয়ে আছে এসব বৈশিষ্ট্য, দেশের জনগণ জানে এসব বন্ধুরা।’

এর আগে সকালে জাতীয়তাবাদী রিকশা ভ্যান অটো শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের নিয়ে রিজভী জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এ সময়ে ভ্যান অটো শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারি শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, স্বেচ্ছাসেবক দলের সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু ছিলেন।

শেয়ার করুন