সম্প্রতি অনলাইনে প্রকাশ হয়েছে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মৌসুমী আক্তার সালমার গাওয়া দ্বৈত গান ‘বোকা মন’। এছাড়া নন্দিনী সিনেমায়ও তার গান সাড়া ফেলেছে শ্রোতামহলে। নতুন গান, চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতা এবং সংগীতাঙ্গনের চ্যালেঞ্জসহ নানা প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন এই তারকা শিল্পী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: আপনার নতুন দ্বৈত গান ‘বোকা মন’ নিয়ে ভক্তদের মধ্যে দারুণ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এই গানটির বিশেষত্ব কী এবং সহশিল্পী হিসেবে শুভ ভাইয়ের [কাজী শুভ] সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সালমা: ‘বোকা মন’ গানটি আমার জন্য ভীষণ আনন্দের একটি কাজ। গানটির কথা, সুর এবং সংগীতায়োজন সবকিছুই খুব চমৎকার হয়েছে। গানটির মূল বিশেষত্ব হলো এর গভীর রোমান্টিক আবেদন, যা তরুণ শ্রোতাদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। শুভ ভাইয়ের [কাজী শুভ] সঙ্গে এটি গাওয়া দ্বিতীয় গান (প্রথমটি ছিল ‘সানাই’), আর তাঁর সঙ্গে কাজ করাটা সব সময়ই একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। তাঁর কণ্ঠের সঙ্গে আমার কণ্ঠের একটা চমৎকার ভারসাম্য তৈরি হয়, যা শ্রোতাদের কাছে শ্রুতিমধুর লাগে। রেকর্ডিংয়ের সময় আমরা দুজনেই চেষ্টা করেছি যেন গানের ইমোশন এবং মূল বার্তাটি শ্রোতাদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারি। শ্রোতাদের কাছ থেকে যে বিপুল ভালোবাসা পাচ্ছি, তাতে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ। এটি প্রমাণ করে, ভালো কথা ও সুরের গান সবসময়ই সমাদৃত হয়।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে আপনার ‘বোকা মন’ দ্বৈত গানটি অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। দ্বৈত গান গাওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেন?
সালমা: দ্বৈত গান গাওয়ার ক্ষেত্রে আমি কয়েকটি বিষয়কে খুব গুরুত্ব দেই। প্রথমত, সহশিল্পীর সঙ্গে আমার কণ্ঠের একটা ভারসাম্য থাকা জরুরি। শ্রোতারা যেন সহজে গানটির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারে, তার জন্য সঠিক ইমোশন এবং ভয়েস মডুলেশন দরকার। দ্বিতীয়ত, গানের কথা ও সুরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। গানটির মূল বার্তাটি যেন আমরা দুজনেই সমানভাবে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, সেই চেষ্টা থাকে। আর তৃতীয়ত, দ্বৈত গান মানেই তো দুই শিল্পীর মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়া। রেকর্ডিংয়ের সময় সেই বোঝাপড়াটা যত ভালো হয়, গানটা ততটাই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ‘বোকা মন’ গানটিতে আমরা সেই চেষ্টাটাই করেছি। ভবিষ্যতে আরও সুন্দর সুন্দর দ্বৈত গানে শ্রোতাদের সামনে আসার ইচ্ছা আছে।
প্রশ্ন: সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘নন্দিনী’ সিনেমায় আপনার একটি গান রয়েছে...
সালমা: বেশ বিরতির পর চলচ্চিত্রে আমার গাওয়া কোনো গান প্রকাশ পেয়েছে। গানটি গেয়েছিলাম পাঁচ বছর আগে। এটি শুনে মানুষ ভালো বলছেন। যারা শুনেছেন, তারা বলেছেন অনেক দিন পর একটি ভালো গান শুনলাম। আমার সমসাময়িক অনেক শিল্পীই সিনেমায় গান করছেন। সিনেমায় আমার কাজ একেবারেই কম।
প্রশ্ন: সিনেমায় গান কম করার কারণ কী?
সালমা: এই সময়ে সিনেমায় যারা সংগীত পরিচালক আছেন, তাদের সঙ্গে আমার খুব একটা যোগাযোগ নেই। শ্রদ্ধেয় আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, ইমন সাহাসহ অনেক গুণী সংগীত পরিচালকের সঙ্গে গান করেছি। সংগীত ক্যারিয়ারে ৩০টির বেশি সিনেমায় গান করার সুযোগ হয়েছে। প্রায় ১০ বছর সিনেমার গানের প্রস্তাব খুব একটা পাচ্ছি না। এ কারণেই সিনেমার গান কমে যাচ্ছে। আমি অডিও বাজার, স্টেজ শো নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সিনেমার গান কমে গেলেও কোনো অসুবিধা নেই। ইদানীং সিনেমায় ব্যবহৃত ফোক গান আধুনিক গানের শিল্পীরা গাইছেন। এটি শুনলে খারাপ লাগে। আমরা যেহেতু ফোক গান বেশি গাই, সেহেতু আমাদের কাছে এ ধরনের গানের প্রস্তাব আসতেই পারত। তবে এটি নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কাউকে দোষারোপও করতে চাই না।
প্রশ্ন: আপনি লোকগানের শিল্পী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু নানা ধরনের গান করছেন...
সালমা: শিল্পী হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকতে চাই না। এ জন্য লোকগানের পাশাপাশি আধুনিক, রক ফিউশনসহ নানা ধরনের গান গাইছি। এর চেয়ে বড় বিষয়, আমার কণ্ঠে শ্রোতারা ভিন্ন ঘরানার গান শুনে মুখ ফিরিয়ে নেননি; বরং অনেকেই ভিন্ন ঘরানার গান গাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমি সেসব শ্রোতার কথা ভেবেই ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার গান করছি।
প্রশ্ন: লোকগানের প্রতি আপনার যে ভালোবাসা, সেটি আপনার গায়কি এবং বর্তমান কাজের ধারায় কীভাবে প্রভাব ফেলে? ফোক গানের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে আপনারা শিল্পীরা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?
সালমা: লোকগান আমার শিকড়, আমার পরিচয়। আমি লোকগানের শিল্পী হিসেবেই পরিচিত এবং এটাই আমার আত্মার সঙ্গে মিশে আছে। আমার গায়কীর ভিত্তিটাই তৈরি হয়েছে লোকসংগীতের সুর, তাল আর ভাবের ওপর নির্ভর করে। যদিও আমি বিভিন্ন ঘরানার গান গাইছি, তবুও আমার প্রতিটি গানে, বিশেষ করে আধুনিক বা ফিউশন গানেও, লোকগানের একটা নিজস্ব টান বা একটা শেকড়ের গন্ধ সবসময়ই থেকে যায়। এটা আমার গায়কীর একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য।
লোকগানের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের, অর্থাৎ শিল্পীদের ওপর অনেকটা বর্তায়। এই ক্ষেত্রে আমরা বেশ কিছু ভূমিকা রাখতে পারি। প্রথমত, লোকগানের আসল সুর, ভাষা এবং ভাবকে অক্ষুণ্ন রেখেও সেগুলোকে বর্তমান সময়ের উপযোগী করে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। অর্থাৎ, ‘ফোক ফিউশন’ বা ‘ফোক রক’-এর মতো নতুন আঙ্গিকে গান তৈরি করা, যেখানে পুরোনো ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক সংগীতায়োজনের একটা সুন্দর মিশ্রণ থাকবে। এতে নতুন প্রজন্ম সহজেই আকৃষ্ট হবে। দ্বিতীয়ত, লোকগানের পেছনের গল্প, গানগুলোর দার্শনিক দিক বা যে সংস্কৃতিকে তারা বহন করে, সে সম্পর্কে তাদের জানাতে হবে। শুধুমাত্র গান গেয়ে গেলেই হবে না, বরং এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য তুলে ধরতে হবে। তৃতীয়ত, বিভিন্ন স্টেজ শো, কনসার্ট বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লোকগানকে আরও বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। তরুণ মিউজিশিয়ানদের লোকগানের কাজ করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। আমার মনে হয়, লোকগান চিরন্তন এবং এর আবেদন সবসময়ই থাকবে। আমরা শুধু একটা সেতু হিসেবে কাজ করতে পারি, যাতে এই ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হতে পারে। আমার ‘সালমা মিউজিক’ চ্যানেলের মাধ্যমে আমি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি, যাতে নতুন আঙ্গিকে হলেও ফোক গানগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
প্রশ্ন: শিল্পীদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক সময় সমালোচনা ও ট্রল হয়। এ বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
সালমা: ব্যক্তিগত বিষয় নয়, প্রত্যেক মানুষের কাজকে সম্মান করা উচিত। বাংলাদেশে তারকার ব্যক্তিগত বিষয় পেলে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। এটি ঠিক নয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তারকার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাতামাতি কমই হয়। তারকাদের ব্যক্তিগত বিষয় সামনে এলে শিল্পীর ক্ষতি হয়ে যায়। আমি মনে করি, ব্যক্তিগত বিষয়টি ব্যক্তিগতই রাখা উচিত। কাজের জায়গায় কাজ।
প্রশ্ন: সংগীতে এই সময়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
সালমা: চ্যালেঞ্জ সব জায়গায় আছে। তবে মিউজিক সব সময়ই চ্যালেঞ্জের জায়গায় ছিল। দেশের কোনো কিছু হলে সবার আগে গান বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্য কোনো কাজ বন্ধ হয় না। শিল্পীদের কাজের কোনো গ্যারান্টি নেই। করোনার সময় শিল্পীদের বেশ দুর্দিন যাচ্ছিল। সেই কঠিন সময়ই মোকাবিলা করেছি। আশা করছি, সব ধরনের চ্যালেঞ্জই শিল্পীরা মোকাবিলা করতে পারবেন।
প্রশ্ন: সালমা মিউজিক চ্যানেলটি কেমন চলছে?
সালমা: আলহামদুলিল্লাহ। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গান প্রকাশ করছি। শ্রোতারা এটি বেশ গ্রহণ করছেন। নতুন কিছু গান তৈরি আছে। সামনে সেগুলো একে একে প্রকাশ পাবে।