নিউইয়র্ক সিটির ১৭ হাজার সরকারি পদ শূন্য


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 10-09-2025

নিউইয়র্ক সিটির ১৭ হাজার সরকারি পদ শূন্য

নিউইয়র্ক সিটিতে বেসরকারি চাকরির বৃদ্ধির হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। সিটি গভর্নমেন্ট পরিচালিত সংস্থাগুলোর মধ্যে ১৭ হাজারেরও বেশি পূর্ণকালীন পদ এখনো খালি। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়েও নিয়োগে গতি ফিরেছে বলে দাবি করা হলেও বহু ইউনিয়ন নেতা, আইনপ্রণেতা এবং সরকারি কর্মীদের মতে এই গতি এখনো অপ্রতুল। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো ব্যাহত হচ্ছে, কর্মীরা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ছেন এবং শহরজুড়ে পরিষেবার মান নেমে গেছে।

সরকারি সংস্থার কার্যক্রমে এই স্টাফ সংকটের বাস্তব প্রভাব ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। পারফরম্যান্স রিপোর্ট অনুযায়ী, আশ্রয়কেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন কমেছে, মেডিকেল এক্সামিনার অফিসে অটোপসির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে এবং ফায়ার অ্যালার্ম ইন্সপেকশন সম্পন্ন করতে সময় বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সম্প্রতি লেজিওনেয়ারস রোগের একটি প্রাদুর্ভাবও পরিস্থিতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিল্ডিংগুলোর কুলিং টাওয়ার যথাসময়ে ইন্সপেক্ট না হওয়ায় জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ যদিও সরাসরি স্টাফ ঘাটতিকে দায়ী করছে না, তবে তারা স্বীকার করছে যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে পানি বিশারদ নিয়োগ করা প্রয়োজন।

নিউইয়র্ক সিটি গভর্নমেন্টের বিভিন্ন স্তরের পুলিশ, কারাকর্মী, শিক্ষক, সমাজকর্মী, ইঞ্জিনিয়ার, ট্যাক্স অ্যাসেসর, মেকানিকসহ নানা শ্রেণির পেশাজীবীসহ কয়েক লাখ কর্মচারী রয়েছেন। তবুও আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত ১৭ হাজার ৯৪২টি পূর্ণকালীন পদ খালি পড়ে রয়েছে। ২০২৩ সালের বাজেটে একটি ‘২-ফর-১’ নীতি চালু হয়, যার অধীনে দুটি পদ খালি না হলে একটি পদ পূরণ করা সম্ভব নয়। যদিও নিয়োগ স্থগিত ঘোষণা করা হয়নি, কিন্তু এ নীতি কার্যত নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ২০ বছরের অভিজ্ঞ নিউইয়র্ক সিটি কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ শহরে বহু বছর ধরেই একটা নীতি চলে আসছে। খালি পদ মানেই বাজেট বাঁচানো। অথচ এই চিন্তাধারা সম্পদ নষ্ট করে কর্মীদের ক্লান্ত করে, সেবা ভেঙে দেয়। এ বক্তব্যের পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। কোভিডের আগে ২০২০ সালে, মেয়র বিল ডে ব্লাসিওর সময় সিটি কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার। কিন্তু কোভিডের পর অনেকেই অবসরে চলে যান বা বাধ্যতামূলক অফিসে ফেরার কারণে চাকরি ছাড়েন। অন্যদিকে বেসরকারি খাত উচ্চ বেতন ও হাইব্রিড ওয়ার্কের সুযোগ দিয়ে সরকারি খাত থেকে মেধা কেড়ে নিচ্ছে।

মেয়র এরিক অ্যাডামস ২০২২ সালে দায়িত্ব নিয়ে ২৫ হাজার খালি পদ পান। তার প্রশাসন বাজেট সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে ৭ হাজার পদ বাতিল করে এবং নিয়োগ মেলার মাধ্যমে কিছু পদ পূরণ করে। এর ফলে ভেকেন্সি রেট বর্তমানে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশে নেমেছে, যদিও কোভিডের সময় এটা ছিল প্রায় ৮ শতাংশ। তবে এ হ্রাস অনেকাংশে কাগজকলমে। এর কারণ অনেক পদই বাজেট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, বাস্তব নিয়োগ হয়নি।

অফিসে কর্মী কম থাকায় চাপ বেড়েছে অবশিষ্ট কর্মীদের ওপর। অনেকেই অভিযোগ করছেন, তারা একাধিক জনের কাজ করছেন একই বেতনে, কোন স্বীকৃতি ছাড়াই। একজন প্রযুক্তি বিভাগীয় কর্মী বলেন, একজন কর্মী চলে গেলে তার কাজ সরাসরি আমাদের ঘাড়ে পড়ে। না ইনক্রিমেন্ট, না স্বীকৃতি। মানুষ এভাবে আর টিকতে পারছে না’। একই অবস্থা ট্যাক্স অ্যাসেসরদের ক্ষেত্রেও। অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে অনেকে বেসরকারি খাতে যাওয়ার কথা ভাবছেন।

মেয়র অ্যাডামস প্রায়শই বলেন, নিউইয়র্ক সিটিতে এখন ‘সবচেয়ে বেশি চাকরি’ রয়েছে। মূলত বেসরকারি খাতের দিকে ইঙ্গিত করে। তবে সরকারি কর্মীদের মধ্যে এ বক্তব্য ঘিরে রয়েছে অসন্তোষ। কাউন্সিল সদস্য কারমেন ডে লা রোসা বলেন, মেয়রের টিম যখন বলে মোস্ট জবস এভার, তখন ভাবি-কোথায়? আমাদের ডিপার্টমেন্টে তো লোক নেই।

সরকারি সংস্থাগুলোও নিয়োগে পিছিয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে ৩ হাজারের বেশি, করেকশন ডিপার্টমেন্টে দেড় হাজার এবং মেডিকেল এক্সামিনার অফিসে ৩৬টির জায়গায় মাত্র ২০টি পদ পূরণ হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের মানসিক স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিভাগে ২৭ শতাংশ পদ ফাঁকা রয়েছে। এটি সরাসরি নিউইয়র্ক নগরবাসীর সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।

স্টাফ ঘাটতির এই সমস্যাটি শুধু সেবা নয়, শহরের আয়েও প্রভাব ফেলছে। রাজস্ব উৎপাদনকারী বিভাগ যেমন ট্যাক্স অ্যাসেসরদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আয়ও হ্রাস পাচ্ছে। ইউনিয়ন নেত্রী ক্যান্ডিস ফিকালোরা বলেন, নতুন ভবন বা জটিল সম্পত্তির মূল্যায়ন করার জন্য অভিজ্ঞ অ্যাসেসর দরকার। কিন্তু কর্মী নেই, তাই আয়ের সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। বর্তমানে নিউইয়র্ক সিটিতে সর্বমোট ১৭ হাজার ৯৪২ খালি পদ রয়েছে। ২৭ শতাংশ ভেকেন্সি মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে। ৩ হাজারের বেশি পদ খালি নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে, এক হাজার পাঁচ শতাধিক পদ খালি করেকশন বিভাগে ও ২০ শতাংশের বেশি খালি পদ নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলে।

নিয়োগে দেরির আরেক বড় কারণ হল সিটি বাজেট অফিস। সংস্থা থেকে প্রার্থী নির্বাচন করা হলেও সিটি বাজেট অফিসের অনুমোদন পেতে অনেক সময় লেগে যায়, কখনো কখনো মাসের পর মাস। একজন প্রাক্তন করেকশন অফিসার বলেন, চাকরি অফার পাওয়ার পর আমি তিন মাস ধরে অপেক্ষা করেছি সিটি বাজেট অফিস অনুমোদনের জন্য। কারো ক্ষেত্রে এটা আট মাসও লেগেছে। কাউন্সিল মেম্বার জুলি মেনিন বলেন, এ কারণে আমরা অনেক যোগ্যপ্রার্থী হারিয়ে ফেলছি, তারা অন্যখানে চলে যাচ্ছে। মেয়র অ্যাডামসের প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। মুখপাত্র লিজ গার্সিয়া বলেন, মেয়র অ্যাডামস দায়িত্ব নেওয়ার সময় পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। তারপর থেকেই আমরা ইতিবাচক অগ্রগতি করেছি এবং ৩ হাজার জন নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছি। বাজেট কমিশনের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু রেইন বলেন, মেয়র অ্যাডামস শুরুতে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন-এতো খালি পদ রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। তবে আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো অপ্রতুল এবং অত্যধিক কড়াকড়িভিত্তিক।

এ প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাও আলোচনায় রয়েছে। ২০২৫ সালের নির্বাচনে অ্যাডামস একজন স্বাধীন প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে রয়েছেন ডেমোক্র‍্যাট জোহরান মামদানি, প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো এবং রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়া। একজন সরকারি কর্মী বলেন, আমি মামদানিকে সমর্থন করি, কিন্তু তিনি মেয়র হলেও ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে আমাদের দরকষাকষি চলবে। সবশেষে প্রশ্ন ওঠে সরকারি চাকরির আকর্ষণ কি এখনো টিকে আছে? অনেকেই বলছেন, হ্যাঁ। কারণ বেনিফিট ভালো, চাকরির নিরাপত্তা আছে। একজন প্রবীণ কর্মী বলেন, বেসরকারি চাকরির মতো স্ট্রেস এখানে নেই। তবে এই ভালো দিকগুলো ধরে রাখতে হলে, নিয়োগ ব্যবস্থা আরো দ্রুত, স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত হওয়া জরুরি।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)