বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নাম শবনম। দীর্ঘ ছয় দশকের অভিনয়জীবনে তিনি উপহার দিয়েছেন অসংখ্য স্মরণীয় চরিত্র। ‘হারানো দিন’ দিয়ে যাত্রা শুরু, ‘আম্মাজান’ দিয়ে শেষ দুটি ছবিই ছিল তুমুল জনপ্রিয়। চলতি মাসের ১৭ তারিখ ছিল তার ৭৯তম জন্মদিন। এদিন ঢাকার বারিধরার বাসায় বসে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সাথে ক্যারিয়ার, জীবন, পরিবার ও প্রাপ্তি নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: আজ আপনার এক বিশেষ দিন। কিন্তু বাসায় পরিবেশ খুব নিরব। এর কারণ কি?
শবনম: কারণ জন্মদিন উপলক্ষ্যে সারাদিন ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসছে। পাকিস্তান থেকেই বেশি। দেশের ভেতর পত্রিকা ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা বেশি ফোন করেছে। সারাদিন এমন ব্যস্ততার মধ্যে থেকে রাতে আর কোনো প্রোগ্রাম রাখিনি। তাই বাসার পরিবেশ এতো নিরব। বলা যেতে পারে আমি ইচ্ছে করেই এরকম পরিবেশ কর রেখেছি।
প্রশ্ন: তাহলে তো মনে হয় এই সময়ে আমাদের আপনার বাসায় আসা ঠিক হয়নি?
শবনম: মোটেও না। তোমরা আসায় বাসায় মধ্যে অন্যরকম একটি পরিবেশ হলো। আমি আসলে সবাইকে বাসায় অ্যালাও করি না। তোমাদেরকে ভালো লাগে বলেই গল্প করতে বসলাম। তবে বাসার সামনে এসে ফোন না দিয়ে আগে জানালে ভালো কিছু রান্না করে রাখতাম। তোমরা সেই রান্নাটা মিস করলে।
প্রশ্ন: আপনার হাতের রান্না খাওয়ার আফসোস নিয়েই কিছুক্ষণ গল্প করতে চাই। আপনার ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে।
শবনম: আমারও ভালো লাগবে তোমাদের সঙ্গে পুরনো বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে পারলে। কারণ অনেক বিষয় আছে প্রশ্ন করলে নতুন করে মনে হয়। বয়স হয়েছে। এখন আমার গল্প যদি নতুনদের কোনো কাজে অনুপ্রাণিত করে তাহলে আমার জীবন সার্থক বলে মনে হবে।
প্রশ্ন : হারানো দিন’ সিনেমার গান দিয়েই আপনি দর্শকের মনে জায়গা করে নেন। প্রথম সিনেমাতেই এমন সাড়া-আপনার তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল?
শবনম: সত্যি বলতে, আমি তখন এতটাই নতুন ছিলাম, বুঝতেই পারিনি যে প্রথম সিনেমার একটা গান এতটা জনপ্রিয় হবে! ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি...’ গানটি যখন রেকর্ড করা হয়, তখনই একটা আলাদা অনুভূতি হয়েছিল, কিন্তু মুক্তির পর যখন দেখলাম এই গানটি মানুষের মুখে মুখে, তখন সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলাম। এটা ছিল আমার অভিনয়জীবনের এক স্বপ্নময় সূচনা। মুস্তাফিজ সাহেবের মতো গুণী নির্মাতার সঙ্গে কাজ করতে পারাটা ছিল সৌভাগ্যের। প্রথম ছবিতেই সুপারহিট হওয়া অনেকের কপালে জোটে না। তখন থেকেই মনে হয়েছিল-এটা শুধু শুরু, সামনে অনেক পথ হাঁটতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার ক্যারিয়ারের প্রথম ও শেষ ছবিই ছিল হিট। এ অভিজ্ঞতা কেমন?
শবনম: এটা সত্যিই এক অদ্ভুত সুখের ব্যাপার। আমার অভিনীত প্রথম ছবি হারানো দিন যেমন ছিল দর্শকের প্রিয়, তেমনি আমার শেষ ছবি আম্মাজান ও দর্শকের মন জয় করে নেয়। প্রথম ছবিতে আমাকে বলা হয়েছিল ‘রূপনগরের রাজকন্যা’, শেষ ছবিতে সবাই আমাকে ডাকতে শুরু করল ‘আম্মাজান’ নামে। এটা একটা শিল্পীর জীবনের পূর্ণতার প্রতীক। প্রথম ও শেষ, দুটো ছবিই দর্শকের মনে দাগ রেখে গেছে-এটা ভেবেই মন ভরে যায়। আমার জীবনটা যেন একটা বৃত্তের মতো-দর্শকের ভালোবাসা দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই ভালোবাসার মধ্যেই শেষ হয়েছে।
প্রশ্ন: দীর্ঘ সময় পাকিস্তানে কাটিয়েছেন, নাদিমের সঙ্গে ৫০টির বেশি ছবিতে কাজ করেছেন। পাকিস্তানের সময়টা কেমন ছিল?
শবনম: পাকিস্তানে আমি দীর্ঘদিন থেকেছি, কাজ করেছি। ১৯৬৮ সালে করাচিতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি। নাদিমের সঙ্গে আমাদের জুটি দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল। তখন একের পর এক হিট ছবি করছিলাম। পাকিস্তানের মানুষ আমাকে যেভাবে আপন করে নিয়েছিল, তা ভোলার মতো নয়। আমি একমাত্র অভিনেত্রী, যিনি ১৬ বার নিগার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি এটা আমার জন্য এক গৌরবের বিষয়। আজও পাকিস্তানের সহশিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, এটা আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের জায়গা।
প্রশ্ন: পাকিস্তানের সহশিল্পীদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ হয় বলে জানালেন। তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?
শবনম: সম্পর্কটা এত বছর পরেও ঠিক তেমনই আছে-গভীর ও আন্তরিক। আমি মাঝেমধ্যে ফোন করি, ওরাও করে। জেবা, আঞ্জুমান, নাদিম-সবাই এখনো খোঁজ নেয়। ১৫ আগস্ট শুক্রবারও জেবার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। এটা খুবই আনন্দের যে, এত বছর পরেও আমরা একে অপরের কথা মনে রাখি। অভিনয় ছাড়ার পরও ওখানে গেলে দেখা হতো, সময় কাটাতাম। আমাদের সম্পর্কটা কখনো পেশাদার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না-এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ফিরে এসে কেমন সময় কাটছে আপনার?
শবনম: এখন সময়টা অনেকটাই নিজের মতো করে কাটছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ছেলের সঙ্গে আছি। রনি এখন আমার পুরো জগত। ওর ছোটবেলায় কাজের ব্যস্ততায় ওকে সময় দিতে পারিনি, সেটার একটা আফসোস ছিল সব সময়। কিন্তু এখন সেই অভাবটা পুষিয়ে নিচ্ছি। আমরা একসঙ্গে বাইরে যাই, রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, কখনো ঢাকার রাস্তায় হাঁটি। মানুষের ভালোবাসা এখনো পাই, এটা খুব তৃপ্তির। এখন আমি পরিবার, বই, গান, সিনেমা আর কিছু ঘরোয়া কাজের মধ্যেই ডুবে থাকি-তাতেই শান্তি পাই।
প্রশ্ন: আপনার রান্নাবান্না, বাজার-সব কিছু নিজেই সামলান শুনেছি?
শবনম: হ্যাঁ, এখনো বাজারে যাই, নিজেই সব কিনি। মানুষের চেনা প্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে আনন্দ দেয়। অনেকে বলে-‘রূপনগরের রাজকন্যা’ আসছেন, ‘আম্মাজান’ আসছেন। এটা আমার শিল্পীজীবনের বড় পাওয়া। রান্না আমি সব সময়ই উপভোগ করি। ছোট মাছ আমার খুব প্রিয়। ইলিশও পছন্দ করি। মাংস খুব একটা খাই না। মাঝেমধ্যে আমি রান্না করি, আবার রনিও রান্না করে। যদিও ও বাঙালি খাবার কম পছন্দ করে, কিন্তু আমার জন্য রান্না করতে কখনো আপত্তি করে না।
প্রশ্ন: আপনার প্রিয় জায়গা কোনটি? দেশের মধ্যে কোথায় বেড়াতে যেতে ভালো লাগে?
শবনম: আমি সমুদ্র ভালোবাসি। শুটিংয়ের সুবাদে অনেকবার কক্সবাজারে গিয়েছি। ওই জায়গাটার প্রতি একটা অন্যরকম টান তৈরি হয়েছে। এখন শরীর ও বয়সের কারণে দূর কোথাও ঘোরাঘুরি কঠিন, কিন্তু ঢাকার আশপাশে গেলে সমুদ্রতীরেই মন পড়ে থাকে। সমুদ্র দেখলেই মনের ভেতরে এক শান্তি চলে আসে।
প্রশ্ন : একজন মা হিসেবে সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
শবনম: রনি আমার বড় প্রাপ্তি। প্রতিদিনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করি। সে আমার বন্ধু, আমার ছায়া, আমার আত্মার অংশ। মাঝে মাঝে বাইরে যাই, রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, ওর পছন্দ-অপছন্দ বুঝি, সেও আমার কথা ভেবে রান্না করে। মা-ছেলের এই সময়টা আমার জীবনের সেরা অধ্যায়গুলোর একটি।
প্রশ্ন: আপনার মতে একজন শিল্পীর আসল প্রাপ্তি কী? এতগুলো পুরস্কার পেয়েছেন, কোনটা সবচেয়ে দামী মনে হয়?
শবনম: একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মানুষের ভালোবাসা। আমি বহু পুরস্কার পেয়েছি-বাংলাদেশ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ পর্যন্ত। নিগার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি ১৬ বার, যেটা কেউ ভাঙতে পারেনি। কিন্তু আজও যখন মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়ে আমাকে ‘আম্মাজান’ বলে ডাকে, কিংবা বলে ‘রূপনগরের রাজকন্যা আসছেন’-সেই মুহূর্তগুলোই আমার কাছে সবচেয়ে দামি পুরস্কার মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ অভিনয়জীবনে কোন চরিত্র বা সিনেমাটি সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
শবনম: খুব কঠিন প্রশ্ন এটা, কারণ প্রতিটি চরিত্রই আমার হৃদয়ের খুব কাছে। তবে হারানো দিন এবং আম্মাজান-এই দুটি ছবি আলাদা জায়গা দখল করে আছে। একটি আমার সূচনার, আরেকটি আমার পরিণতির প্রতীক। এছাড়া জুলি, জোয়ার ভাটা, নাচের পুতুল, সহধর্মিণী-এই ছবিগুলোর চরিত্রও আমাকে শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে। অনেক সময় শুটিংয়ের কষ্ট, চরিত্রে ডুবে যাওয়া, সব মিলিয়ে প্রতিটি ছবির সঙ্গেই আমার আত্মিক একটা সম্পর্ক রয়েছে।