চঞ্চল চৌধুরী। নামটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অভিনয়ের মুগ্ধতা, চরিত্রে ডুবে যাওয়ার শিল্প আর নিরীক্ষার সাহস। মঞ্চ থেকে টেলিভিশন, ওটিটি থেকে সিনেমা সর্বত্রই নিজের স্বতন্ত্র উপস্থিতি দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সময়ের অন্যতম সেরা অভিনয়শিল্পী। সাম্প্রতিক চরকি-রিলিজ ‘উৎসব’ ও ‘ইনসাফ’এ তার উপস্থিতি আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে, ভালো অভিনয়ের চাহিদা কখনো কমে না। এ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: ‘উৎসব’-এর গল্প ও চরিত্র আপনাকে কীভাবে আলাদা রকমভাবে স্পর্শ করেছে?
চঞ্চল চৌধুরী: ‘উৎসব’ আমার কাছে শুধু একটা সিনেমা নয়, এটা একধরনের নতুন অভিজ্ঞতা। ভূতের চরিত্রে অভিনয় আমরা সাধারণত কল্পনায়ই রাখি, কিন্তু এই ছবিতে আমি, জয়া ও অপি করিম যে ভূত চরিত্রে অভিনয় করেছি, তা খুব মানবিক। গল্পটি মূলত ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’-এর অনুপ্রেরণায় তৈরি, কিন্তু নির্মাতা তানিম নূর যেভাবে এটিকে আমাদের বাস্তবতায় তুলে ধরেছেন, সেটা অনেক গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে।
সিনেমায় হাস্যরস যেমন আছে, তেমনি আবেগ, পরিবার ও সম্পর্কের জটিলতা রয়েছে। আমাদের সমাজে এখন এমন সিনেমা খুব কমই তৈরি হয়, যেটা পুরো পরিবার একসঙ্গে হলে গিয়ে উপভোগ করতে পারে। এই দিকটা আমাকে আলাদা করে ভাবিয়েছে।
প্রশ্ন: ভিন্নধর্মী চরিত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী ছিল?
চঞ্চল চৌধুরী: আমার কাছে চ্যালেঞ্জ সব সময় একটাই আমি যেটা আগে করেছি, তার চেয়ে এবার নতুন কী দিতে পারছি। একজন ভূতের চরিত্র দর্শক কতটা বিশ্বাস করবেন, এটা অনেকটাই অভিনয় আর উপস্থাপনার ওপর নির্ভর করে। এই সিনেমায় আমরা নিজেরাই নিজেদের ব্যঙ্গ করেছি, যা আমাদের সমাজে খুব কম দেখা যায়। সাধারণত আমরা নিজেদের ভুল মানতে চাই না, অথচ এখানে প্রতিটি চরিত্র নিজেকে প্রশ্ন করেছে, নিজের অপূর্ণতা নিয়ে খোলামেলা থেকেছে। এই ব্যাপারটাই আমাকে খুব টেনেছে।
প্রশ্ন: আপনার মতে ‘উৎসব’-এর সাফল্যের মূল রহস্য কী?
চঞ্চল চৌধুরী: সিনেমার প্রচার তো এখন ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে, কিন্তু আমি মনে করি, মুখে মুখে প্রচারের শক্তি এখনো সবচেয়ে কার্যকর। যখন একজন দর্শক তার প্রিয়জনকে বলেন ‘এই সিনেমাটা একবার হলেও দেখতে হবে’, তখন সেটা অনেক বড় প্রভাব ফেলে। ‘উৎসব’-এর ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। দর্শকরা ছবিটিকে ভালোবেসেছেন, তারাই ছবির প্রচার করেছেন। আর হ্যাঁ, এর পেছনে পুরো টিমের নিষ্ঠা, অভিনয়শিল্পীদের আন্তরিকতা আর পরিচালকের মেধাবী কাজসব মিলেই সফলতা এসেছে।
প্রশ্ন: মোশাররফ করিমের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনা হয়। বাস্তবতা কী?
চঞ্চল চৌধুরী: আমরা দুজনই অভিনয়ের মানুষ, একই সময়ে উঠে আসা, একসঙ্গে বহু কাজ করেছি। তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টা আসলে দর্শকের একধরনের কল্পনা। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আছে, শ্রদ্ধাবোধ আছে। কেউ ভালো কাজ করলে আমি অনুপ্রাণিত হই, সেটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেই নিজেকে আরও ভালো করতে। প্রতিযোগিতা থাকেই, কিন্তু সেটা সুস্থ হোক, সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাবান থেকেই হোক, সেটাই আমি চাই।
প্রশ্ন: একজন শিল্পী হিসেবে ছোট কিংবা অতিথি চরিত্র করতে আপনি এত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কেন?
চঞ্চল চৌধুরী: আমি মনে করি, সিনেমা দলগত একটা শিল্প। ফুটবল টিমে যেমন সবাই খেলেন, কিন্তু গোল একজন করেন ঠিক তেমনি সিনেমায় সবার অংশগ্রহণেই সফলতা আসে।
‘ইনসাফ’ বা ‘তুফান’-এর মতো ছবিতে আমার চরিত্র বড় নয়, কিন্তু আমার উপস্থিতি দর্শকের মনে দাগ ফেলেছে এটাই তো গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাতা যখন মনে করেন, একটি দৃশ্যে আমার থাকা দর্শকের মনে চমক আনবে, তখন আমি সেই আস্থার মর্যাদা দিতে চাই।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতের প্রকল্প ‘দম’ নিয়ে প্রস্তুতি কতদূর?
চঞ্চল চৌধুরী: ‘দম’ নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। চিত্রনাট্য প্রায় চূড়ান্ত, শুটিং শিডিউলও নির্ধারণ হচ্ছে। গল্পটা খুব গভীর এটি বেঁচে থাকার, হাল না ছেড়ে দেওয়ার গল্প। যতক্ষণ তোমার দম আছে, ততক্ষণ তুমি লড়াই করে যেতে পারো। এই বার্তাটাই মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। সমাজে হতাশা যখন ঘিরে ধরে, তখন এমন গল্পগুলো আমাদের আবার বাঁচতে শেখায়।
প্রশ্ন: ব্রাত্য বসুর ছবিতে কাজ করছেন এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
চঞ্চল চৌধুরী: হ্যাঁ, শিগগিরই ‘শিকড়’ নামে একটি ছবিতে কাজ করতে যাচ্ছি। এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত হচ্ছে। গল্পের আবহ খুবই বাঙালিয়ানা ও বাস্তবধর্মী। ছবির চরিত্র নিয়ে এখনই কিছু বলতে চাই না, তবে এ রকম সাহিত্যের সাথে যুক্ত হওয়া সব সময়ই সম্মানের। অক্টোবর থেকে শুটিং শুরু হবে।
প্রশ্ন: চরিত্র বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার বর্তমান পদ্ধতি কী? এখন কি আপনি চরিত্র বাছেন, নাকি চরিত্রই আপনাকে খুঁজে নেয়?
চঞ্চল চৌধুরী: এখন একটি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। নির্মাতারা আমাকে নিয়ে ভাবেন, আবার আমি নিজেও দেখি-এই চরিত্রটি আমার আগের চরিত্রগুলোর চেয়ে আলাদা কি না। একই ধরনের কাজ বারবার করলে অভিনেতা হিসেবে নিজেকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা থাকে। তাই অনেক অফার এলেও আমি এখন অনেক বেছে কাজ করি। ওটিটি, সিনেমা, বিজ্ঞাপন-সব মাধ্যমেই কাজ করছি, কিন্তু প্রতিটাতে চেষ্টা থাকে নতুন কিছু দেওয়ার।
প্রশ্ন: আপনার মতে, একজন শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব কতটুকু থাকা উচিত?
চঞ্চল চৌধুরী: আমার কাছে অভিনয় কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং সমাজের দর্পণও। একজন শিল্পী হিসেবে আমরা সমাজের নানা গল্প তুলে ধরি, সেখানে মানুষের সুখ, দুঃখ, প্রতিবাদ, প্রতিবিম্ব সব কিছুই উঠে আসে। আমার বিশ্বাস, আদর্শিক জায়গা থেকে একজন অভিনেতা যদি কাজ করেন, তাহলে তার শিল্প শুধু বিনোদন নয়, সচেতনতা তৈরির মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। মানুষ সিনেমা বা নাটক দেখে নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খোঁজে এটাই সবচেয়ে বড় সামাজিক দায়িত্ব।
প্রশ্ন: অভিনয়জীবনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে, আপনি কি মনে করেন দর্শকের ভালোবাসা ধরে রাখতে পেরেছেন?
চঞ্চল চৌধুরী: আমি কৃতজ্ঞ। এই ভালোবাসা কোনো একদিনে আসেনি। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রশ্ন করেছি ‘এই চরিত্রে আমি কেন, আর কী নতুন দিতে পারি?’ দর্শক সেটাই অনুভব করেন। তারা জানেন, চঞ্চল চৌধুরী মানেই ভিন্ন কিছু। এই বিশ্বাসটাই আমাকে প্রতিদিন নতুন করে শুরু করতে সাহস দেয়।
প্রশ্ন: তরুণ অভিনয়শিল্পীদের জন্য আপনি কী পরামর্শ দিতে চান?
চঞ্চল চৌধুরী: সবচেয়ে বড় কথা তাড়াহুড়ো নয়। অভিনয়কে ভালোবাসতে হবে, ধৈর্য রাখতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার চমক নয়, বরং স্ক্রিপ্ট পড়া, চরিত্র বোঝা আর সাধনা করতে হবে। আপনি যদি সত্যিকার অর্থে নিজের মধ্যে ডুবে যেতে পারেন, তাহলে একদিন না একদিন দর্শক আপনাকে ঠিকই খুঁজে নেবে।