অবশেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বের বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণা এবং ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের আগ্রহী জনগণ জানতে পেরেছে আগস্ট ২০২৪ সরকার পরিবর্তনের ১৮ মাস পর একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বিতর্ক, বিভ্রান্তি, অভিযোগ অনুযোগের অবসানে এখন দেখতে হবে অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে কি না? দেশ-বিদেশে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হয় নির্বাচন?
গুজব আর ষড়যন্ত্রের দেশে ন্যায় বিচার, সুশাসন আর নাগরিক অধিকার সব সময় সুদূর পরাহত। ৩৬ জুলাই ক্ষমতার পালাবদলের কৃতিত্ব এখন অনেক ব্যক্তি-গোষ্ঠী এককভাবে দাবি করলেও এখনো কিন্তু জবাব মেলেনি কিভাবে বৈষম্য ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন রক্তাক্ত পথে সরকার পতনের পরিণতিতে এগিয়েছে? সীমিত সময়ে কাদের পরিকল্পনায় বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতাকে জীবন বিসর্জন দিতে হলো? কাদের সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনায় মহান স্বাধীনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত হতে হলো লক্ষ প্রাণের আত্মৎসর্গের মূল্যে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ?
সবাই স্বীকার করবে কুশাসন, দুর্নীতি, সম্পদ লোপাট করে দেশকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে উপনীত করার জন্য পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের দায়দায়িত্ব ছিল। দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সরকার ছিল দারুণভাবে ব্যর্থ অবাধ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং প্রতিবেশী দেশের খবরদারিকে নিরঙ্কুশ প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে। কঠিন এক সময়ে অসচ্ছ প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনায় দায়িত্বে এসে অন্তর্বর্তী সরকার সব স্টেকহোল্ডারদের সমন্বিত করে দেশকে সংঘর্ষ, সংঘাত আর দুর্নীতিমুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলতে হবে।
যদি আওয়ামী সরকারকে নিজেদের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী করতে হয়, তাহলে বলতে হবে ভিন্ন কিছু করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। নিজেদের মূল দায়িত্বের অতিরিক্ত বিপুল পরিমাণ সংস্কারের কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একটি গোষ্ঠীকে সরকারি প্রণোদনা দিয়ে নিজেদের বিতর্কিত করেছে, একটি অশুভ শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গাছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠী কি কখনো ভেবেছিল এই বাংলাদেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ পরাজিত হবে, মহান মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় জুতোর মালা পরানো হবে?
যদি বিচারব্যবস্থা ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য শেখ হাসিনা সরকারকে দায়ী করা হয়, তাহলে গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার বিচারব্যবস্থা সরকারি প্রভাবমুক্ত করতে পেরেছে? বিগত আমলে মীমাংসিত অনেক সাড়া জাগানো মামলার দণ্ডিত আসামিদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাড়া জাগানো অনেক হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি।
সরকার বিপুল পরিমাণ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির নামে কয়েকটি প্রধান এবং কিছু প্রান্তিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপের পর হঠাৎ করে জুলাই ঘোষণা দেওয়ায় একমাত্র বিএনপি এবং সমমনা কয়েকটি দল ছাড়া অধিকাংশ দ্বিমত পোষণ করেছে। এমনকি সরকার ঘনিষ্ঠ এনসিপি এবং জামাত উষ্মা প্রকাশ করেছে। সচেতন মহল এর পেছনে বিতর্কিত সরকারের নিরাপদ বহির্গমন কৌশল দেখতে পেয়েছে। একই সময়ে লন্ডনে তারেক জিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের আলোচনা এবং এনসিপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের বিতর্কিত কক্সবাজার প্রমোদ ভ্রমণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এককথায় সবকিছু লেজে গোবরে করে সরকার শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। দেখতে হবে এখনো হতাশ, অগোছানো পুলিশ এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ এবং সুযোগসন্ধানী বেসামরিক প্রশাসনকে দিয়ে সরকার কত দ্রুত নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে?
প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে আওয়ামী লীগ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বল্পতম সময়ে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডসমূহের সর্বজনগ্রাহ্য নিরপেক্ষ বিচারকাজ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তিরোহিত। নেতা-নেত্রীদের পাপের কারণে ঐতিহ্যবাহী তৃণমূলে সুসংগঠিত আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রেখে কোনো জাতীয় নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। সত্যিকারের প্রতিযোগিতার অভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আরো একটি দল দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে আবারও ফ্যাসিজম সৃষ্টি হবে না সে নিশ্চয়তা নেই। জনগণ কিন্তু ২০০১-২০০৬ বিএনপি যুগের কথা বিস্মৃত হয়নি।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির নেপথ্যে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ভূমিকা রয়েছে সেটি এখন দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। ভূরাজনীতিতে এখন চীন-ভারত-রাশিয়া শক্তিশালী মৈত্রী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ নিজেকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ক্রীড়াভূমিতে পরিণত করলে পরিণাম শুভ হবে নাকি।
যাহোক শেষকথা নির্বাচন হতে চলেছে। এখন সবাই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশা করতেই পারি। নির্বাচন হলে আর প্রান্তিক রাজনৈতিক দল আর গোষ্ঠীর দাপুটে অবস্থান হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। নির্বাচনে জয়ী দলকেও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আশা করি দেশবাসী সঠিক নেতৃত্ব বেছে নেবে। জাতীয় জীবনে জুলাই-আগস্ট হাসিকান্না নিয়ে বারবার ফিরে আসবে।