যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিমরা শুধু ধর্মীয়ভাবে নয়, শিক্ষাগত দিক থেকেও এগিয়ে আছেন এমন চিত্র উঠে এসেছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের সর্বশেষ জরিপে। ২০২৩-২৪ সালের ‘রিলিজিয়াস ল্যান্ডস্কেপ স্টাডি’ (আরএলএস) অনুযায়ী, আমেরিকান মুসলিমরা অন্য যে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী বা অবিশ্বাসীদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় কলেজ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ শতাংশ মুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কলেজ ডিগ্রি রয়েছে, যার মধ্যে এক চতুর্থাংশেরও বেশি ব্যক্তির পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি রয়েছে। তুলনায়, খ্রিস্টানদের মধ্যে এই হার ১৪ শতাংশ এবং ধর্মনিরপেক্ষদের মধ্যে ১৬ শতাংশ।
শুধু শিক্ষা নয়, ধর্মীয় বিশ্বাসেও মুসলিমরা বেশ এগিয়ে। জরিপ বলছে, প্রতি ১০ জন মুসলিমের মধ্যে ৬ জন মনে করেন ধর্ম তাদের জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে। খ্রিস্টানদের মধ্যেও এই অনুপাতে সংখ্যাটি প্রায় কাছাকাছি, ৫৫ শতাংশ। বিশেষ করে তরুণ মুসলিমরা প্রার্থনা, মসজিদে যাওয়া এবং ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে প্রবীণদের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। প্রতি ১০০ জন মুসলিমের মধ্যে ৫৯ জনই দিনে একাধিকবার নামাজ আদায় করেন, আর ২৮ শতাংশ নিয়মিত নামাজ পড়েন। মাত্র ১৩ শতাংশ বলেন তারা খুব কম অথবা কখনো নামাজ পড়েন না। এছাড়া আমেরিকান মুসলিমদের এক-তৃতীয়াংশই এখনও শিক্ষার্থী, যেখানে খ্রিস্টানদের মাত্র ৬ শতাংশ এবং অবিশ্বাসীদের ১০ শতাংশ শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
গবেষকরা বলছেন, মুসলিমদের এই উচ্চ শিক্ষাগত অর্জন এবং ধর্মীয় অনুশীলন ঐতিহ্যবাহী ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যেখানে মনে করা হতো শিক্ষা বাড়লে ধর্মীয় বিশ্বাস কমে যায়। তবে এত অর্জনের পরেও মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক নজরদারি এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ২০২৪ সালে আরেকটি পিউ জরিপে বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ৭০ শতাংশ মুসলমান মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমবিরোধী বৈষম্য বেড়েছে। এটি কেবল অনুভব নয়, বাস্তব চিত্র। ২০২৩ সালে কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস মুসলিমবিরোধী পক্ষপাতের ৮ হাজারের বেশি অভিযোগ পেয়েছে, যা সংগঠনটির ৩০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এদিকে জরিপে আরো দেখা গেছে, মুসলিমরা শুধু ধর্মে ও শিক্ষায় নয়, সামাজিক দায়িত্বেও সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিম প্রাপ্তবয়স্কদের ৪২ শতাংশই বাড়িতে নাবালক সন্তানের পিতা-মাতা, যেখানে খ্রিস্টানদের মধ্যে এ হার ২৭ শতাংশ এবং ধর্মনিরপেক্ষদের মধ্যে ২৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ মুসলমান হলেও তাদের প্রভাব দেশটির নৈতিক ও সামাজিক জীবনে গভীরভাবে প্রোথিত-এমনটাই বলছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এই গবেষণা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুসলিম সমাজের শিক্ষায় এ অগ্রগতি তাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক মুসলিম পরিবার শিক্ষা ও পেশাদারিত্বকে সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার একটি মূল হাতিয়ার হিসেবে দেখে। এর পাশাপাশি, ধর্মীয় অনুশীলনের প্রতি তাদের দৃঢ় অঙ্গীকার কমিউনিটির মধ্যে ঐক্য এবং মানসিক সুস্থতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরো একটি দিক হলো, মার্কিন মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয় রক্ষা করতে সচেষ্ট, যেখানে তারা বৈষম্য ও অবমাননার বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের জন্য সক্রিয়ভাবে লড়াই করছেন। শিক্ষাগত ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদের এ সফলতা একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়, যা ভবিষ্যতে আরো বেশি সংহতি ও অংশগ্রহণের পথ খুলে দিচ্ছে। সংক্ষেপে, আমেরিকান মুসলিমরা শিক্ষায় অগ্রগতি অর্জনের পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চায় অটুট রয়েছে। তরুণ প্রজন্ম ধর্মকে জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের এ অগ্রগতি সত্ত্বেও তারা বৈষম্য ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ তথ্যসমৃদ্ধ পর্যালোচনা মার্কিন মুসলিমদের সমগ্র চিত্রকে তুলে ধরে, যা ধর্ম, শিক্ষা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে একটি নতুন ভারসাম্য স্থাপন করার সম্ভাবনা নিয়ে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমরা উচ্চশিক্ষা এবং ধর্মীয় অনুশীলনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, যা তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃঢ়তার প্রতিফলন। এই তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণা পুরনো ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, যে শিক্ষা বৃদ্ধি পেলে ধর্মীয় বিশ্বাস কমে যায়, এবং একই সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলমান বৈষম্য ও নজরদারির বাস্তবতা তুলে ধরে।