গোপালগঞ্জ রণক্ষেত্র হওয়ার দায় কার?


সালেক সুফী , আপডেট করা হয়েছে : 23-07-2025

গোপালগঞ্জ রণক্ষেত্র হওয়ার দায় কার?

রাজনৈতিক সংঘাত, পুলিশের গুলিতে খুন, দিনের পর দিন কারফিউ, মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারা, স্বাভাবিক কাজকর্ম, অফিস-আদালত স্থবির হয়ে যাওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম, চারদিকে ভীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি, জনমনে আতঙ্ক এসবই দেখা গেল গোপালগঞ্জে। গোপালগঞ্জ মানেই যে শুধু আওয়ামী লীগ এটা ঠিক নয়। এখানে দলীয় লোকজনের বাইরে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের বসবাস। এদের অনেকে দল করে, সেটা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ইসলামি দলসমূহ থেকে শুরু সব ধরনেরই। এর বাইরেও বহু লোকজন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, যেটা বাংলাদেশের অন্যসব স্থানেও রয়েছে। গোপালগঞ্জ মানেই আওয়ামী লীগ এটা মোটেও সঠিক কথা না। কিন্তু সম্প্রতি কিছু ঘটনায় গোটা গোপালগঞ্জে নেমে এসেছে অশান্তির খড়গ!

বিশেষ করে জুলাই আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণ স্মরণীর দিনে কেন রক্ত রঞ্জিত হলো গোপালগঞ্জ-এ প্রশ্ন সর্বত্র? দেশের বিভিন্ন অংশ বিশেষত রংপুরে এইদিনে গণআন্দোলনে প্রথম জীবন বিসর্জন করি আবু সাঈদকে স্মরণ করা হচ্ছিল ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায়। দুঃখজনকভাবে সেই বিশেষ দিনে প্রাণ হারালো অন্তত ৬ জন জনতা। এ পরিণতির দায় কি বর্তমান সরকার এড়াতে পারে? নাকি ক্ষমতার অন্ধ মোহে উন্মত্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো দায়দায়িত্ব নেই? নাকি অন্ধকারের শক্তি নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য মেটিকুলাস পরিকল্পনা করছে। 

তরুণ শক্তির সংযুক্তিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক দল এনসিপি দেশজুড়ে জনসংযোগের জন্য পদযাত্রায় উত্তর বাংলা, দক্ষিণ বাংলায় জনসংযোগ করছে। সে ধারাবাহিকতায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্গম দুর্গ গোপালগঞ্জেও অনুষ্ঠান করার প্ল্যান করেন এনসিপি নেতারা। নাম দেওয়া হয়েছিল মার্চ টু গোপালগঞ্জ। কোণঠাসা বর্তমানে রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আর তার সংগঠন সুযোগের সন্ধানে আছে। আর গোপালগঞ্জে তাদের দুর্গম দুর্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ দাপিয়ে বেড়ানো তরুণ শক্তির আস্ফালনকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার ঘোষণা ওরা দিয়ে রেখেছিল। ওদের হয়তো বাড়তি আশঙ্কা ছিল মব সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুর কবর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় কি না। সরকারের কি উচিত ছিল না যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া? সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে অবশ্যই আগাম সংবাদ ছিল। কেন আগে থেকে উভয় পক্ষকে সতর্ক করা, বাড়তি জনবল সমবেত করে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নিশ্চিত করা হলো না? এনসিপির নেতা-নেত্রীদের উচ্চারণে ছিল উসকানি। আর পতিত সরকারের সহযোগী অঙ্গ প্রতিষ্ঠাগুলো এনসিপিকে প্রতিহত করার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। 

বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক পরিণতি। সেনাপ্রধান আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন-‘রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বে যেন দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না হয়’। সেনাবাহিনী এখনো সরকারের সহায়তায় নিয়োজিত। কেন তারাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না? যখন এনসিপির সমাবেশস্থল ভাঙচুর করা হয়েছিল, তখনো কিন্তু তাদের কাফেলা সভাস্থলে পৌঁছেনি। এমনটা করাও তো উচিত হয়নি। এক দল সভা করবে এটাই স্বাভাবিক। এটা তাদের অধিকারও। কিন্তু সম্ভাব্য এক পরিস্থিতি এড়াতে আগে ১৪৪ ধারা এ জাতীয় কিছু ঘোষণা করার রেকর্ড আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কিন্তু গোপালগঞ্জে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে কেন গোপালগঞ্জের প্রশাসন এমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি- এসবই প্রশ্নবোধক হয়ে রয়েছে। 

তাছাড়া ঘটনার ওই মুহূর্তে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সভা স্থগিত করা হলে দুঃখজনক ঘটনা ঘটতো না। প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী কেন শুভবুদ্ধির পরিচয় দিলো না? আমি কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের সমর্থন করছি না। একইভাবে উত্তেজনাকর কথা বলে এনসিপি নেতা-নেত্রীদের সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া বাহনে পালিয়ে যাওয়ার পরিণতি শুভ হলো না। আমি মনে করি, সর্বশেষ পরিস্থিতির জন্য ব্যর্থতা সরকারের এবং তাদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের। 

সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে ২০২৬ ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে নির্বাচন হবে। নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো বাহাস করছে। পরস্পরের প্রতি নোরাং ভাষায় কাদা ছোড়াছুড়ি করছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০-২৫ শতাংশ ভোটারের কথা বিবেচনায় না নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলাই বাহুল্য। সরকারের একজন ছাত্র উপদেষ্টা নির্বাচন কমিশনের তালিকায় নৌকা প্রতীক রাখার জন্য সমালোচনা করেছে। এটি কি তার নিরপেক্ষতার সঙ্গে মানানসই? 

মোদ্দাকথা হলো, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে থাকা পতিত সরকারের সমর্থকরা সুযোগ বুঝে মরণ কামড় দেবে। সেটি জানা সত্ত্বেও গোপালগঞ্জের দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেওয়া সরকারের ব্যর্থতা। এক বছর পর সরকারের উপদেষ্টাদের মুখে পুলিশের ব্যর্থতার অজুহাত দেওয়া শোভা পায় না। 

আশা করি, সরকার নিজেদের স্বার্থে পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন করবে। না হলে অন্ধকারের শক্তিগুলো মাথা ছাড়া দিয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে। প্রশ্ন উঠবে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার আদৌ আন্তরিক কি না? জুলাই-আগস্টে যে আদর্শ এবং স্বপ্নকে ধারণ করে সাধারণ মানুষ সংগ্রাম করেছিল তার সামান্য অর্জন হয়েছে কি না নিশ্চিত নই।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)