জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও গায়িকা রুমানা রশীদ ঈশিতা। এক সময় নাটক ও সংগীতে সরব উপস্থিতি ছিল যার, আজ তিনি অনেকটাই আড়ালে। তবে হঠাৎ করেই ফিরে এলেন নতুন মৌলিক গান ‘রুপোর ঝলক’ নিয়ে। এই গান, শিল্পজগত থেকে বিরতি, বর্তমান ব্যস্ততা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: পাঁচ বছর পর নতুন গান ‘রুপোর ঝলক’। গানটির পেছনের গল্পটা জানতে চাই।
ঈশিতা: প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি আসিফ ইকবাল ভাইয়ের একটি নাটকে অভিনয় করেছিলাম, নাটকটির নাম ছিল ‘কেন’। তখনই তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তার একটি গান আছে- ’রুপোর ঝলক’, যেটি আমার কণ্ঠে নিতে চান। আমি তখনই রাজি হয়ে যাই। গানটির কথা ও সুর শুনে আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই সময়েই গানটির রেকর্ডিং হয়ে যায়। তবে গানটি করার সময় আমি জানতাম না, এটি কোথায় ব্যবহৃত হবে- নাটকে, সিনেমায়, না আলাদা মিউজিক ভিডিও হিসেবে। আমি কখনোই এই বিষয়গুলো জিজ্ঞেস করিনি, কারণ আমি গানটি নিজের ভালো লাগা থেকে গেয়েছিলাম। পরে জানতে পারি, গানটি নাটকে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন সেটি ’নসিব’ নামের নাটকে যুক্ত হয়েছে।
প্রশ্ন: গানটি এতদিন পর প্রকাশের কারণ কী বলে মনে করেন?
ঈশিতা: এই গানটির ভয়েস রেকর্ড হয়েছিল প্রায় দুই বছর আগে। তবে এটি প্রকাশ হতে এতটা সময় লেগেছে কেন- সেটি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না। আসলে এই ব্যাপারটি গাঙচিল মিউজিক কতৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। আমি যেহেতু গানটি গেয়েছি একান্ত নিজের ভালো লাগা থেকে, তাই কখন প্রকাশ পাবে বা কিভাবে ব্যবহার হবে, এসব নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাইনি। সুর ও কথা সুন্দর হলে আমি তাতেই সন্তুষ্ট থাকি। আসিফ ভাই যখন বলেছিলেন, আমি চোখ বুঁজেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: দর্শক-শ্রোতাদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও গানে আপনি অনিয়মিত কেন?
ঈশিতা: এই প্রশ্নটা আমাকে অনেকেই করে। সত্যি বলতে, একজন নারীর জীবন বদলে যায় সংসার শুরু করার পর। বিশেষ করে মা হওয়ার পর। আমার ছেলেমেয়েদের বড় করতে গিয়ে আমার সময়ের বড় একটা অংশ তাদের দিকেই দিতে হয়েছে। আমার ছেলে এখন ক্লাস টেন শেষ করেছে, কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। মেয়ে-ছেলেকে সময় দেওয়া, তাদের সঙ্গে মানসিক ও আবেগিকভাবে সম্পৃক্ত থাকা- এসব ছিল আমার অগ্রাধিকার। এছাড়াও আমার মা বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার চিকিৎসা ও সেবাযত্নেও আমি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। তাই এই সময়টায় গানের চেয়ে পরিবারই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন যদিও ব্যস্ততা কিছুটা কমেছে, তবুও সেই সময়ের অনুপস্থিতির পেছনে এই কারণগুলোই ছিল মূল।
প্রশ্ন: এখন কি আপনাকে নাটকে দেখা যাবে?
ঈশিতা: হ্যাঁ, অবশ্যই দেখা যেতে পারে- তবে সেটা নির্ভর করছে ভালো স্ক্রিপ্ট ও সময়ের ব্যবস্থাপনার ওপর। আমি এখন আর আগের মতো একের পর এক নাটকে কাজ করতে পারি না। এখন চাই এমন কিছু কাজ করতে যা আমার সময় ও পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করবে। এমন চরিত্রে কাজ করতে চাই, যেটা আমার বয়স, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই হবে। এখন অনেক সময় স্ক্রিপ্ট আসে, কিন্তু বেশিরভাগই খুব সাধারণ, অথবা এমন চরিত্র যেখানে আমি কেবল একটি সহায়ক ভূমিকায় থাকি। আমি চাই এমন গল্পে কাজ করতে, যেখানে আমি কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকি, অথবা গল্পটা আমার আশেপাশে আবর্তিত হয়।
প্রশ্ন: আপনার সময়কার নাটকের সঙ্গে এখনকার নাটকের কী পার্থক্য দেখেন?
ঈশিতা: আমাদের সময়ে নাটকের সংখ্যা যেমন কম ছিল, তেমনি কাজগুলো ছিল অনেক মনোযোগ দিয়ে করা। এখন নাটকের উৎপাদন অনেক বেড়েছে, প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। ইচ্ছা করলেই এখন কেউ ইউটিউব বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নাটক তৈরি করতে পারে। এতে যেমন নতুন প্রতিভার উত্থান ঘটছে, তেমনি মানহীন অনেক কনটেন্টও তৈরি হচ্ছে। এখন প্রতিদিন এত নাটক আসে যে, ভালো কাজগুলো অনেক সময় দর্শকের চোখ এড়িয়ে যায়। আগে মানুষ সপ্তাহে বা মাসে নির্দিষ্ট কিছু নাটক দেখত। এখন হাজারো কনটেন্টের ভিড়ে মানসম্মত নাটকগুলো অনেক সময় হারিয়ে যায়। এই অবস্থাটা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বেই এখন এমন।
প্রশ্ন: বর্তমানে ব্যস্ততা কী নিয়ে?
ঈশিতা: এই মুহূর্তে আমার ব্যস্ততা মূলত পরিবার ও নিজের জীবনকে ঘিরেই। ছেলে-মেয়ে এখন বড় হচ্ছে, তারা অনেকটাই নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারে। আমি এখন কিছু ছোটখাটো ব্যবসা করছি, তবে সেগুলো নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাই না। এই ব্যবসাগুলো আমার আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতা ধরে রাখার একটা অংশ বলা যায়। একেবারে ঘরে বসে ইেন- নিজেকে নিয়ে ভাবছি, নিজের জন্য সময় বের করছি, বই পড়ছি, লেখালেখি করছি। সেই অর্থে বলা যায়, এখন আমি একটু নিজের মধ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতে গান বা নাটকে ফেরার পরিকল্পনা আছে?
ঈশিতা: অবশ্যই আছে। কিন্তু শর্ত একটাই- গল্পটা যেন আমাকে টানে, গানটির কথা-সুর যেন মনে দাগ কাটে। আমি এখন এমন এক অবস্থানে আছি, যেখানে শুধু পরিসংখ্যানের জন্য কাজ করতে চাই না। অভিনয় বা গান- দুটোই আমার ভীষণ প্রিয়, তাই মনের মতো কিছু পেলে নিশ্চয়ই ফিরব। তবে সেটা হতে হবে পরিপূর্ণ প্রস্তুতির সঙ্গে।
প্রশ্ন: ‘নসিব’ নাটকে আপনার গান ব্যবহার হয়েছে। নাটকটি দেখেছেন কি?
ঈশিতা: না, এখনো দেখা হয়নি। তবে আমি শুনেছি গানটি নাটকে খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু এটি আমার গাওয়া গান, অবশ্যই সময় করে নাটকটি দেখব। আমি সবসময়ই চাই, আমার কাজ যেন মানুষের মনে দাগ কাটে- এটা সেই চেষ্টারই অংশ।
প্রশ্ন: লেখালেখি কি এখনও করছেন?
ঈশিতা: এক সময় নিয়মিত লিখতাম- প্রবন্ধ, ছোটগল্প, এমনকি কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতিও লিপিবদ্ধ করতাম। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার সময় এসব কিছুই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার সময় পাচ্ছি, নিজেকে গোছাচ্ছি, তাই আবার লেখার দিকে মনোযোগ দিতে পারছি। আশা করছি, শিগগিরই নতুন কিছু লেখা নিয়ে সামনে আসতে পারব।
প্রশ্ন: নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ঈশিতা: নতুন প্রজন্ম খুব প্রতিভাবান, তারা অনেক কিছু একসঙ্গে শিখছে, করছে। কিন্তু তাদের পথটা আগের চেয়ে কঠিন, কারণ এখন তারা শুধু দেশীয় শিল্পীদের নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়ও টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তাই আমার পরামর্শ হবে- নিরাশ হয়ো না। ভালো কাজ সবসময় টিকে থাকে, মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। আন্তরিকতা, অধ্যবসায় আর শেখার মানসিকতা থাকলে তারা নিশ্চয়ই অনেক দূর যাবে।
প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি বলে মনে হয়?
ঈশিতা: অনেক স্মৃতি আছে, কিন্তু যদি একটি বেছে নিতে হয়, তবে বলব- ‘নীলের আকাশে আমি ঝলমলে রোদ’ গানটি যখন প্রচারিত হয়েছিল, তখন যে ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেটিই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত। এখনো কেউ কেউ সেই গানটি গেয়ে আমাকে শোনায়, স্মৃতি রোমন্থন করে। এটা শিল্পী হিসেবে আমার জীবনের এক অমূল্য অর্জন।
প্রশ্ন: আপনার মতে একজন শিল্পীর সবচেয়ে জরুরি গুণ কী হওয়া উচিত?
ঈশিতা: আমি মনে করি, একজন শিল্পীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো নম্রতা ও নিজেকে প্রতিনিয়ত শোধরানোর মানসিকতা। একজন শিল্পীকে সবসময় শেখার মনোভাব নিয়ে চলতে হয়। জনপ্রিয়তা সাময়িক, কিন্তু যদি একজন শিল্পী শেখা বন্ধ করে দেয়, তাহলে সে থেমে যায়। শিল্প মানেই পরিবর্তনশীলতা, আর সেটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে শিল্পীও পিছিয়ে পড়ে।