প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বাক্ষরিত ওয়ান, বিগ বিউটিফুল বিল নামের বিশাল ট্যাক্স কাট আইনটি দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। যদিও এটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্য আইন নয়, তবে ২০১০ সালের অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট (ওবামাকেয়ার)-এর পর এটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতিতে সবচেয়ে বড় নীতিগত হস্তক্ষেপ। বিলটির মাধ্যমে একদিকে কর ছাড়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও অন্যদিকে মেডিকেইড, শিশুস্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচি, ওবামাকেয়ার এক্সচেঞ্জ এবং গ্রামীণ হাসপাতালসহ একাধিক স্বাস্থ্যসেবামূলক কর্মসূচিতে এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাজেট ছাঁটাই করা হয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিম্নআয়ের মানুষ, শিশুরা এবং প্রত্যন্ত এলাকার রোগীরা যারা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা-বেষ্টিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। আইনটি স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও প্রবেশাধিকারকে আরো জটিল ও সীমিত করে তুলবে বলে নীতিবিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা সংগঠনগুলোর আশঙ্কা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০ মিলিয়ন দরিদ্র ও প্রতিবন্ধী নাগরিকের জন্য ব্যবহৃত এই প্রোগ্রামে যোগ্যতা ও নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় বড় পরিবর্তন আসছে। বিলটি সরাসরি স্বাস্থ্যখাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। মেডিকেইড বাজেট আগামী ১০ বছরে প্রায় ১৮ শতাংশ কমানো হবে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি হচ্ছে, ১৯ থেকে ৬৪ বছর বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি মাসে কমপক্ষে ৮০ ঘণ্টা কাজ, শিক্ষা বা স্বেচ্ছাসেবায় অংশ নেওয়ার প্রমাণ দেখাতে হবে। এটি ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। এছাড়া প্রতি ছয় মাস অন্তর মেডিকেইড যোগ্যতা যাচাই করা হবে এবং অনাগরিকদের জন্য অংশগ্রহণে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিলটিতে লিঙ্গ সনাক্তকরণ সংক্রান্ত চিকিৎসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং প্ল্যানড প্যারেন্টহুডের মতো ক্লিনিকগুলোর জন্য সরকারি তহবিল বন্ধ করার বিধান রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দরিদ্ররা
যেসব ব্যক্তি ফেডারেল দারিদ্র্যসীমার ১০০শতাংশ থেকে ১৩৮ শতাংশের মধ্যে আয় করেন (একটি চার সদস্যের পরিবারের জন্য বার্ষিক আয় প্রায় ৩২ হাজার ১৫০ ডলার থেকে ৪২ হাজার ৭৬০ ডলার), তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এই আইন অনুসারে, ৬৫ বছরের নিচের প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত প্রতি মাসে ৮০ ঘণ্টা কাজ, স্বেচ্ছাসেবা বা শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে নইলে তারা মেডিকেইড কভারেজ হারাবেন।
নতুন এই কাজের শর্ত ২০২৬ সালের ডিসেম্বর থেকে চালু হবে এবং প্রমাণপত্র জমা দিয়ে ছয় মাস অন্তর এটি প্রমাণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনেক মানুষকে কভারেজ হারাতে বাধ্য করবে। এমনকি যারা যোগ্যতা রাখেন, তারাও কভারেজ হারাবেন। গর্ভবতী নারী, প্রতিবন্ধী, বন্দি ও পুনর্বাসনকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিরা এই নিয়মের বাইরে থাকলেও তাদেরও আলাদাভাবে তা প্রমাণ করতে হবে।
অতিরিক্ত খরচ ও সীমাবদ্ধতা
২০২৭ সাল থেকে স্টেটগুলোকে প্রতিটি মেডিকেইড ব্যবহারকারীর যোগ্যতা ছয় মাস অন্তর যাচাই করতে হবে, যার ফলে বছরের মাঝামাঝি কভারেজ হারানোর ঝুঁকি বাড়বে। এছাড়া যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আয় করেন, তাদের চিকিৎসাসেবায় কো-পেমেন্ট দিতে হবে। এই কো-পেমেন্ট বার্ষিক আয়ের ৫ শতাংশ পর্যন্ত হবে। যদিও প্রাথমিক চিকিৎসা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধের খরচ এর আওতার বাইরে থাকবে। এছাড়া আইনটি গর্ভপাতসেবা দেওয়া ক্লিনিকগুলোর ওপর ফেডারেল মেডিকেইড তহবিল বন্ধ করে দিচ্ছে, যা বিশেষভাবে প্ল্যানড প্যারেন্টহুডকে লক্ষ্য করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ২৪টি স্টেটে ২০০টি কেন্দ্র ঝুঁকিতে রয়েছে।
ওবামাকেয়ার এক্সচেঞ্জেও কঠোরতা
নতুন আইনটি অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্টের (ওবামাকেয়ার) এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থাকেও কঠোরভাবে প্রভাবিত করবে। প্রিমিয়াম ভর্তুকি পেতে হলে এখন নাগরিকদের আগে থেকেই যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত তাৎক্ষণিক কভারেজ শুরু করা যেত, কিন্তু নতুন নিয়মে তা বন্ধ হচ্ছে। এছাড়া বিশেষ এনরোলমেন্ট পিরিয়ডে নাম লেখানো ব্যক্তিরাও আর ভর্তুকি পাবেন না। ২০২৮ সাল থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃনিবন্ধন বন্ধ হবে, ফলে প্রতি বছর নাগরিকদের নতুন করে তথ্য আপডেট করতে হবে।
বিলটিতে শিশুস্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচি চিলড্রেনস হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রামের বাজেটেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাটছাঁট করা হয়েছে, যদিও নির্দিষ্ট কোনো আর্থিক পরিমাণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এই কর্মসূচিটি মূলত তাদের জন্য, যারা মেডিকেইডের আওতায় পড়েন না, তবে যাদের পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য বেসরকারি স্বাস্থ্যবীমা গ্রহণের মতো নয়। প্রস্তাবিত বিলের অধীনে ফেডারেল সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় রাজ্য সরকারগুলোকে হয় নিজেদের বাজেট থেকে অতিরিক্ত অর্থ যোগ করতে হবে, না হয় সুবিধাভোগী শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। নীতিবিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই বাজেট সংকোচনের ফলে বহু শিশু ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হতে পারে। এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো, যাদের জন্য চিলড্রেনস হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রোগ্রামএকটি একমাত্র নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা সুবিধা। অর্থাৎ বাজেট কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত সরাসরি শিশুদের চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার এবং সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গ্রামীণ হাসপাতালের জন্য সংকট
এই বিল গ্রামীণ হাসপাতালগুলোর জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্টেট পর্যায়ে প্রোভাইডার ট্যাক্স ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে আগামী ১০ বছরে প্রায় ১৯১ বিলিয়ন ডলার কম খরচ হবে, যার মধ্যে ৫৮ বিলিয়ন ডলার কমবে শুধু গ্রামীণ হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে। যদিও একটি ৫ বছরের ৫০ বিলিয়ন ডলারের ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য তহবিল’ রাখা হয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একে ‘ব্যান্ড এইড’ বলেই অবজ্ঞা করেছে।
আমেরিকার এসেনশিয়াল হাসপাতালগুলোর প্রধান ব্রুস সিগেল বলেছেন, এই আইনে কোটি কোটি আমেরিকান তাদের স্বাস্থ্যসেবা হারাবেন এবং হাসপাতালগুলো অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। অসুস্থ মানুষ কভারেজ হারাবে, হাসপাতালগুলো দুর্বল হবে। এটি এক বিপর্যয়ের রেসিপি।
বিলটি নিয়ে রিপাবলিকানদের মধ্যেও কিছুটা দ্বিধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র পাঁচজন (২ জন প্রতিনিধি ও ৩ জন সিনেটর) বিরোধিতা করেন। আইনটি সেনেটে ৫১-৫০ ভোটে এবং হাউসে ২১৮-২১৪ ভোটে পাস হয়। এই বিল স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নতুন এক অধ্যায় শুরু করলেন। কিন্তু অনেকের জন্যই তা হবে স্বাস্থ্যসেবার সংকোচনের ও দুর্ভোগের অধ্যায়।