ট্রাম্পের গ্র্যান্ট অ্যান্ড ডিপোর্ট নীতি


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 18-06-2025

ট্রাম্পের গ্র্যান্ট অ্যান্ড ডিপোর্ট নীতি

ট্রাম্প প্রশাসনের ‘গ্র্যান্ট অ্যান্ড ডিপোর্ট’ নীতির ফলে আশ্রয়প্রার্থীদের জীবনে তৈরি হচ্ছে গভীর সংকট। অনেকেই আদালতে জিতে গেলেও বন্দি থাকতে হচ্ছে বা তৃতীয় এমন দেশে পাঠানো হচ্ছে যেখানে তাদের নিরাপত্তা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চাওয়া হাজার হাজার মানুষ এখন এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে বন্দি, যেখানে তাদের মানবিক অধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিও হেফাজত করা হচ্ছে না। ইকুয়েডর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী জেসিকার মতো মানুষের গল্পই প্রকাশ করছে বর্তমান নীতির বাস্তব চিত্র, যা অনেকের জন্য ‘জিতে হারার অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। জিতেও হারতে হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘গ্র্যান্ট অ্যান্ড ডিপোর্ট’ নীতির প্রভাব পড়ছে অসংখ্য অভিবাসীর জীবনে-এমনকি তাদের ওপরও যারা আদালতে নিজেদের নির্যাতনের প্রমাণ দেখিয়ে রায় জিতেছেন, তারাও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। এই নীতির জ্যান্ত উদাহরণ জেসিকা, যিনি ইকুয়েডর থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তার স্বামী এবং একজন সরকারি কৌঁসুলির হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী দেওয়ার পর। যুক্তরাষ্ট্রে এসে তিনি শরণার্থীর মর্যাদা চাইলেন। কিন্তু শুনানির আগেই বিচারক তাকে বলেন- সে যতই প্রমাণ দিক না কেন, শেষ পর্যন্ত তাকে কোথাও না কোথাও ডিপোর্ট করা হবে। হয়তো ইকুয়েডর নয়, কিন্তু আমেরিকাতেও থাকতে দেওয়া হবে না। তবুও জেসিকা মামলায় লড়লেন এবং আদালত তার ‘অপসারণ স্থগিতকরণ’ আবেদন মঞ্জুর করল। ফলে তাকে ইকুয়েডরে ফেরত পাঠানো যাবে না। কিন্তু বছরখানেক ধরে তিনি এখনো বন্দি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। এমনকি আপিলে জিতলেও তাকে মেক্সিকোতে পাঠানো হবে বলে জানানো হয়েছে।

এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের একটি মূলনীতি ছিল: কেউ যদি সরাসরি আশ্রয় না পায়, বরং সীমিত সুরক্ষা পায়, তবে তাকে অন্য কোনো দেশে পাঠানো হবে বা কারাগারে পাঠানো হবে। এই নীতিই এখন কার্যকর রয়েছে, এবং বাইডেন প্রশাসনের কিছু বিধান এটিকে আরো কঠিন করে তুলেছে। ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসন ‘বৈধ পথের ফাঁকি’ নামের একটি নীতি চালু করে, যা বলে দেয় যে সীমান্ত পয়েন্টের বাইরের কোনো প্রবেশকারী সাধারণভাবে আশ্রয়ের যোগ্য নয়। এরপর ২০২৪ সালে, একটি জরুরি আদেশে সীমান্তে আসা অধিকাংশ মানুষদের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, যতক্ষণ না সীমান্তে আগমনের হার কমে। এমন পরিস্থিতিতে যারা শরণার্থী সুরক্ষা চাচ্ছেন, তাদের একমাত্র ভরসা অপসারণ স্থগিতকরণ বা কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চারের আওতায় সীমিত সুরক্ষা পাওয়া। কিন্তু এই সুরক্ষাও এখন কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।

জিতেও বন্দি, জিতেও হুমকি, জিতেও বহিষ্কার

যারা ‘অপসারণ স্থগিতকরণ’ পান, তাদের অনেকেই বছরের পর বছর কমিউনিটিতে থেকে কাজ করার সুযোগ পেতেন, যদিও তাদের মাথার ওপরে একটি বহিষ্কারের আদেশ ঝুলতো। কিন্তু এখন তাদের বন্দি রাখা হচ্ছে, যখন সরকার চেষ্টা করছে অন্য কোনো দেশ খুঁজে পেতে-যেমন এল সালভাদোর বা দক্ষিণ সুদানের মতো দেশ, যারা বন্দিদের গ্রহণ করে। এরই শিকার কিলমার আবরেগো গার্সিয়া, যিনি ট্রাম্পের আগেই এই সুরক্ষা পেয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন তাকে পুনরায় আটক করে এবং পরে তাকে সেকট কারাগারে পাঠিয়ে দেয়, যা তার সুরক্ষার শর্ত লঙ্ঘন করে। সরকার আদালতে স্বীকার করেছে যে, এটি ছিল একটি ভুল, কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়, এটি কীভাবে ঘটলো বা এমন ঘটনা কতবার ঘটেছে।

আরেকজন ওসিজি নামে একজন অভিবাসী, যুক্তরাষ্ট্রে থেকে গুয়াতেমালায় ফেরত পাঠানো থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে মেক্সিকো পাঠানো হয়, যেখান থেকে তিনি আবার গুয়াতেমালায় ফেরত পাঠানো হন। এই ধরনের ‘চেইন রিফুলমেন্ট’ আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের লঙ্ঘন হলেও যুক্তরাষ্ট্র এতে সচেতন মনোভাব দেখায়নি। যারা অপসারণ স্থগিতকরণ পান, তারা উচ্চপর্যায়ের প্রমাণ দিয়ে দেখাতে সক্ষম হন যে নিজ দেশে গেলে নির্যাতনের শিকার হবেন। কিন্তু বর্তমান নীতি কার্যত এই সুরক্ষাকেই অর্থহীন করে তুলেছে। তাদের জয়ের পরও বন্দি রাখা হচ্ছে অথবা এমন দেশে পাঠানো হচ্ছে যেখানে তাদের নিরাপত্তা নেই। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি এতোটাই নিরুৎসাহজনক যে অনেকেই শুনানির আগেই হাল ছেড়ে দেন এবং নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন-জানি, তারা নির্যাতনের সম্মুখীন হবেন। এই ধরনের নীতিমালা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার চেতনার পরিপন্থীই নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধেও দাঁড়ায়। অভিবাসন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এভাবে ‘জিতেও হারা’ নীতি শরণার্থীদের ন্যূনতম মর্যাদা ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অভিবাসন নীতির বাস্তবায়ন-বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘গ্র্যান্ট অ্যান্ড ডিপোর্ট’ নীতি এবং বাইডেন প্রশাসনের কড়া সীমাবদ্ধতামূলক বিধান-আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এক গভীর অনিশ্চয়তা ও মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। আদালতে আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েও তারা বন্দি থাকছেন, অথবা এমন দেশে পাঠানো হচ্ছে যেখানে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই।

এই নীতিগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মানবাধিকার ও আশ্রয় নীতির পরিপন্থী নয়, বরং আন্তর্জাতিক শরণার্থী সুরক্ষা নীতিরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অপসারণ স্থগিতকরণ বা কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চারের মতো সীমিত সুরক্ষাকে কার্যত অর্থহীন করে তোলা হচ্ছে। ফলে অনেকে ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে বিপজ্জনকভাবে নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন বলে প্রমাণ দিতে পেরেছেন, তাদের ন্যূনতম সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত। ন্যায়বিচার শুধু আদালতের রায়ে সীমাবদ্ধ নয়, তা বাস্তবায়নের মধ্যেও নিহিত। সুরক্ষা দেওয়া মানে কাগজে অনুমোদন নয়-তা হওয়া উচিত বাস্তব নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং মানবিক সহানুভূতির বাস্তবায়ন। এখন সময় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রকে তার অভিবাসন নীতিতে মানবিকতা ও ন্যায় ফিরিয়ে আনার।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)