দুটি ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার ধূমায়িত সংকটে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সন্দেহাতীতভাবে। কাশ্মীরে সংগঠিত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের জেরে গত কিছুদিন ধরে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত-পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দুয়ারে পৌঁছেছিল। আপাতত দৃষ্টিতে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। আশা করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ১৯৪৭ থেকে চলতে থাকা সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে। সাময়িকভাবে হলেও স্বস্তি আসবে।
অন্য ঘটনাটি হলো তথাকথিত, মেটিকুলাস পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগ সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষিদ্ধ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুলাই আগস্ট ২০১৪ হত্যাকাণ্ডের নির্ভরযোগ্য নিরপেক্ষ বিচার না করেই আওয়ামী লীগের মতো তৃণমূলে বিস্তৃত রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কতটুকু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সময় সেটি নির্ধারণ করবে। তবে এটুকু বলা যায় এর সুদূরপ্রসারি রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিক্রিয়া সরকারকে নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জিং করবে সন্দেহ নেই।
প্রথম ঘটনাটি বিশ্বশান্তির পটভূমিতে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। রাশিয়া-ইউক্রেন এবং গাজা সংকট চলমান থাকা অবস্থায় পাক-ভারত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বশান্তি বিনষ্ট হতো সন্দেহ নেই। বিশ্ব নিঃসন্দেহে দুই বিবদমান শিবিরে বিভক্ত হয়ে যেত। যুদ্ধের পরিণতি বহন করতে হতো উপমহাদেশের কোটি কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার আর নির্বাচন নিয়ে যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক মহলের প্রভাবে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক, না বেঠিক কাজ করেছে সেটি বিচার করবে দেশবাসী। বিচারকাজ চলাকালে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পথে হাঁটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে না। বাংলাদেশে সংঘটিত অসংখ্য হত্যাকাণ্ড। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হোতাদের বিচারকাজ সম্পন্ন না করে কিছু প্রান্তিক রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হঠকারী হলো কি না— ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
বিচারের মর্মকথা হলো, অপরাধীর বিচার হোক কিন্তু নির্দোষ যেন শাস্তি না পায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বাধীনতাবিরোধী গণহত্যাকারী, ব্যাংক লুটেরা, সন্ত্রাসী, অর্থপাচারকারী, খুনিরা অবাধে সমাজে দাপট দেখাচ্ছে। সেখানে স্বাধিকার আর স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী একটি দলকে বিচারে প্রমাণ না করেই নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া কতটা যুক্তিযুক্ত সময় সেটি প্রমাণ করবে। ২০২৫ বাকি সময় কঠিন হবে বাংলাদেশের। সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
কঠিন এই সময়ে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য গঠিত সংস্থা সার্ক নিষ্ক্রিয়। ওআইসি বা জাতিসংজ্ঞ আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি নিরসনের চেষ্টা করছে না। কাশ্মীরের পর্যটন শহর পাহেলগামে কথিত সন্ত্রাসী আক্রমণ নিয়ে নানা গুজব নানা মিডিয়ায়। কেন জাতিসংঘ বা পরাশক্তিগুলোর উদ্যোগে কাশ্মীর হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত করা যাচ্ছে না। সংঘাত আর সংঘর্ষ কখনো কোনো কিছুর সমাধান নয়। কাশ্মীর সমস্যা সেই ১৯৪৭ থেকে ঝুলে আছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা বা পরাশক্তিগুলো কখনো আন্তরিক উদ্যোগ নেয়নি সমাধানের। ফলে অঞ্চলের চারটি দেশ পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ সন্ত্রাস আক্রান্ত। এই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের অভিশাপ মুক্ত হতে পারছে না।
ভারত ঘটনার পর পরেই পাকিস্তানকে দোষারোপ করে একতরফা সিন্ধু চুক্তি বাতিলসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। জবাবে পাকিস্তান শিমলা চুক্তি স্থগিত করা পাল্টাব্যবস্থা গ্রহণ করলো। এরপর শুরু যুদ্ধ। আবার অবস্থা বেগতিক দেখে থামলোও। এই অঞ্চলে আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ সংলগ্ন মায়ানমারের পরিস্থিতি সবার জানা সমস্যা আছে ভারত চীনের। আছে ভূ-মধ্যসাগর এলাকায় পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীনের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। শোনা যাচ্ছে, ভারতের সাত অঙ্গরাজ্য, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের কথা। কেউ চাইছে আরাকান রাজ্যে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। ভারত, বাংলাদেশসংলগ্ন ‘চিকেন নেক’ নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত। একইভাবে যুদ্ধ বিক্ষুব্ধ মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে মানবিক সাহায্য পাঠানোর জন্য করিডোর স্থাপনের কথা সোনা যাচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন স্পর্শকাতর দেশ।
দুশ্চিন্তার বিষয় বাংলাদেশে এখন জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। জাতি নানা গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভাজিত। প্রধান রাজনৈতিক দল এবং প্রান্তিক দলগুলো চাইছে ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন। এই মুহূর্তে দেশের স্বার্থে দল মোট নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
জুলাই আগস্ট ২০২৪ গণহত্যা, সন্ত্রাসী ঘটনাবলির কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত বা কার্যকরি বিচারব্যবস্থা আদৌ কখনো হবে বলে সন্দেহ। নানা কন্সপাইরেসি থিওরি বিরাজমান। যতদিন যাচ্ছে নিত্যনতুন পটভূমি আবিষ্কৃত হচ্ছে। দেশটি যে যুদ্ধ করে অনেক রক্ত আর অশ্রুর বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে সেটি অনেকেই ভুলে যাচ্ছে। জুলাই আগস্ট ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত সংঘটিত মব জাস্টিস, ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ব অবাক দেখেছে। এগুলোর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী অবিলম্বে বৃহত্তর পরিসরে জাতীয় একতার উদ্যোগ নিতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো দল বা গোষ্ঠীর হঠকারী আন্দোলন জাতীয় ঐক্য বিনাশী হবে। দেশনেত্রী তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন। অতীতের সব বিভেদ ভুলে দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তিনি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান করতে পারেন। ভারত-পাকিস্তান সংঘাত থেকে আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব সংকটাপন্ন হতে পারে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের উসকানিতে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলে পরিণতি শুভ হবে না। বাংলাদেশের উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় প্রান্ত এখন স্পর্শকাতর।
আশা করি, দেশবাসী বিশেষত প্রধান রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক শক্তিগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হবে।