যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় ১৯২৯ সালে, নর্থ ডাকোটার ছোট শহর রসে। এটি মূলত সিরিয়া ও লেবানন থেকে আগত মুসলিম অভিবাসীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যারা কৃষিকাজ ও পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
শতবছরেরও কাছাকাছি সময় ধরে, এই মসজিদ মুসলিম অভিবাসীদের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় জীবনযাত্রার প্রতীক হয়ে রয়েছে। ১৯৭০-এর দশকেমসজিদটি মুসল্লিদের ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অযত্নে ধসে পড়ে। বর্তমানেও মুসল্লিদের অভাবে এই মসজিদে কোনো নামাজ আদায় হয়না। যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র মসজিদ যেখানেবছরের পর বছর কোনো নামাজ আদায় হয় না। মসজিদেরআশপাশে নেই কোনো মুসলিম বাসিন্দা। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাদের কয়েকজনের নাতিপুতিরা তাদেরপূর্বপুরুষদের স্মৃতি রক্ষায় প্রতীকীভাবে এই মসজিদটিআবারো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন। যদিও তারা কেউই মুসলিম নন।
মসজিদের প্রাঙ্গণে কবরস্থানে প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, ওমর এবং তার মেয়ে মেরিও মরের চিরনিদ্রা/ ছবি সংগৃহীত
তারা ইসলাম ধর্ম থেকে হারিয়ে গেছেন। মসজিদের আঙিনায় রয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। প্রতিটি কবরে রয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের মুসলিম নাম ফলক। ১৮৮০-এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের লেভান্ট অঞ্চল বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ফিলিস্তিন থেকে বহুমানুষ যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন শুরু করে। অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে অনেকেই আমেরিকায়পাড়ি জমান।
এই অভিবাসীদের বেশিরভাগই প্রথমে নিউইয়র্ক, ওহাইও, মিশিগান ও মিনেসোটা হয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসরহন। নর্থ ডাকোটার বিস্তীর্ণ কৃষিভিত্তিক এলাকায় সস্তায় জমিপাওয়া যেত, কারণ ১৮৬২ সালের হোমস্টেড অ্যাক্ট অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অভিবাসীদের কৃষিকাজের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে জমি বরাদ্দ করছিল। এই সুবিধা গ্রহণকরেই বহু মুসলিম পরিবারর সশহরে বসতি স্থাপন করেন এবং ধীরে ধীরে তাদের ধর্মীয় চর্চার জন্য একটি উপাসনালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
নর্থ ডাকোটার প্রচণ্ডশীত ও প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও মুসলিম অভিবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদের জীবন প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয়বিশ্বাস ও ঐতিহ্য বজায়রাখার লক্ষ্যে তারা ১৯২৯ সালে রস শহরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মসজিদ নির্মাণকরেন। এই মসজিদটি ছিল কাঠের তৈরি একতলা একটি সাধারণ ভবন। ভেতরেছিলমাটির মেঝ এবং একটি ছোট মেম্বার। এটি শুধু নামাজ আদায়ের স্থান ছিলনা, বরং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সামাজিক ও ধর্মীয়কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মসজিদ প্রতিষ্ঠাতাদের কবরস্থানে, ওমরের নাতি রিচার্ড ওমর, যিনিএকজনঅমুসলিম, তার পিতামহের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন/ছবি সংগৃহীত
রস মসজিদের প্রতিষ্ঠার পেছনে কয়েক জন বিশিষ্ট মুসলিম অভিবাসীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিরিয়ান কৃষক এলিয়াস জ্যাকব, যিনি স্থানীয়মুসলিমদের সংগঠিত করে ধর্মীয়কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। লেবাননের অভিবাসী ব্যবসায়ী হাসান জাফর মসজিদের নির্মাণ কাজে আর্থিক সহায়তা দেন। এছাড়া নাসের হোসেন নামে এক প্রভাবশালীমুসলিমমসজিদের জন্য জমি দান করেন। মোহাম্মদ শেইখ নামে একজন ধর্মীয় নেতা ও ইমাম এই মসজিদে নামাজের ইমামতি করতেন এবং স্থানীয় মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদান করতেন।
১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে মুসলিম অভিবাসীদের নতুন প্রজন্ম উচ্চশিক্ষা ও চাকরির সন্ধানে বড় শহরগুলোর দিকে চলে যেতে থাকলে রস শহরের মুসলিমজনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যায়। ফলস্বরূপ, মসজিদের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭০-এর এবং অবশেষে ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েক দশক ধরে এটি বিস্মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে এবং শুধুমাত্র স্থানীয় মুসলিম অভিবাসীদের কিছু পরিবারই এর ইতিহাস সম্পর্কে জানতো।
দীর্ঘদিন পর, রস শহরের মুসলিম অভিবাসীদের উত্তরসূরিরা তাদেরপূর্বপুরুষদের স্মৃতিরক্ষার জন্য ২০০৫ সালে একই স্থানেএকটি ছোটআধুনিকমসজিদ পুনর্নির্মাণ করেন।
নতুন মসজিদটি ইটের তৈরি এবং একটি ছোট গম্বুজবিশিষ্ট স্থাপনা হিসেবেগড়ে তোলা হয়। এটি এখন ঐতিহাসিকনিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম অভিবাসীদের ঐতিহ্য রক্ষার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।রস মসজিদ শুধুমাত্র একটি উপাসনালয়নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতীক। যখন এটি ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। কিন্তু আজকেরদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ লাখেরও বেশিস মুসলমান বসবাস করছেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ৩ হাজার ২০০-এর বেশি মসজিদ রয়েছে, যা প্রমাণকরে যে মুসলিম অভিবাসীরা শতবছর আগেই আমেরিকার অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিলেন। রস মসজিদ সেই ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য, যা মুসলিম অভিবাসীদের ত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতি চিত্র বহন করে।
রস মসজিদ যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম অভিবাসীদের সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমেরিকায় ইসলাম কোনো নতুন ধর্ম নয়, বরং এটি বহু শতাব্দীধরে এখানে চর্চিত হয়ে আসছে। যদিও মূল মসজিদটি এখন আর নেই, তবে এর উত্তরসূরিরা ধর্মীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রস মসজিদ যুক্তরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক ধর্মীয় সহাবস্থানের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিরস্থায়ী স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।