যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের একটি জুরি ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিশু ওয়াদে আলফাইউমির হত্যাকাণ্ড এবং তার মায়ের ওপর নৃশংস হামলার ঘটনায় বাড়িওয়ালা জোসেফ চুবাকে হত্যাকাণ্ড এবং বিদ্বেষমূলক অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। ২০২৫ সালের ১ মার্চ জুরি বোর্ড অভিযুক্ত ল্যান্ডলর্ড জোসেফ চুবাকে (৭৩) হত্যাকাণ্ড এবং বিদ্বেষমূলক অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর শিকাগো থেকে ৪০ মাইল দূরের প্লেনফিল্ডে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। দোষী ল্যান্ডলর্ড জোসেফ চুবার বাড়ির ভাড়াটিয়া হানান শাহিন এবং তার ছয় বছর বয়সী ছেলে ওয়াদে আলফাইউমিকে মুসলিম বিদ্বেষে ছুরিকাঘাত করেন। পুলিশ ও প্রসিকিউটররা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পরপরই মুসলিম বিদ্বেষ থেকে এই হামলা চালানো হয়। আদালতে শিশুটির মা হানান শাহিন সাক্ষ্য দেন যে, হামলার দিন খুনি চুবা প্রথমে তাকে ছুরিকাঘাত করেন এবং পরে তার ছেলেকে ২৬ বার ছুরিকাঘাত করেন। শিশুটির নিথর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ, তখনো তার শরীরে ছুরি বিদ্ধ ছিল। আদালতে পুলিশের উপস্থাপিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের পর চুবাকে বাড়ির বাইরে রক্তাক্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। একটি সামরিক ধাঁচের ৭ ইঞ্চি (১৮ সেমি) ব্লেডযুক্ত ছুরি দিয়ে ওয়াদেকে ২৬ বার ছুরিকাঘাত করেন। ২০২৩ সালের এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে, জোসেফ চুবাকে ফার্স্ট-ডিগ্রি হত্যাকাণ্ড, হত্যাচেষ্টা, দুটি গুরুতর আঘাত এবং দুটি বিদ্বেষমূলক অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
প্রসিকিউটররা জানান, চুবা মুসলমানদের বিদ্বেষ করতেন এবং গাজার যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই তিনি শাহিনকে বাড়ি ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর মাত্র কয়েক দিন পর হামাসের ইসরায়েলে আক্রমণের পর, ৭৩ বছর বয়সী বাড়িওয়ালা জোসেফ চুবা, যিনি ওয়াদে এবং তার মা হানান শাহিনের বাড়ির মালিক ছিলেন, এক মর্মান্তিক হামলা চালান। একটি ৭ ইঞ্চি (১৮ সেমি) সামরিক ধাঁচের ছুরি দিয়ে তিনি ওয়াদেকে ২৬ বার ছুরিকাঘাত করেন, যার ফলে শিশুটি মারা যায়। হামলার সময় হানান শাহিন, যিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন, আদালতে সাক্ষ্য দেন যে, হামলাকারী চুবা তাকে বলেছিলেন, তুমি মুসলমান, তোমাকে মরতে হবে।
এই ঘটনা প্লেনফিল্ড, ইলিনয়ের একটি বাড়িতে ঘটে, যেখানে হানান শাহিন প্রথমে আক্রমণের শিকার হন এবং পরে তার ছেলে ওয়াদে চুবার হাতে নির্মমভাবে হত্যা হন। আদালত ও পুলিশ তদন্তে জানিয়েছে যে, চুবা হামলার সময় বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেন, হানানকে আক্রমণ করেন এবং পরে ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালান। হামলার সময় তিনি শিশুটির মা শাহিনকে বলেছিলেন, তুমি মুসলমান, তোমাকে মরতে হবে। মা হানান শাহিনের শরীরে এক ডজনের বেশি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তবে দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন।
চুবার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, গুরুতর আঘাত ও বিদ্বেষমূলক অপরাধের মোট আটটি অভিযোগ আনা হয়। আগামী ২ মে তার সাজা ঘোষণা করা হবে।
ওয়াদে আলফাইউমির বাবা ওদাই আলফাইউমি সংবাদ সম্মেলনে আরবিতে বলেন, আমি জানি না আমি খুশি হবো, নাকি দুঃখিত হবো। আমি হাসবো নাকি কাঁদবো, বুঝতে পারছি না। মানুষ আমাকে হাসতে বলছে, কিন্তু আমি তো সেই শিশুটির বাবা, যে আর নেই। আমার মনে হচ্ছে এই রায় অনেক দেরিতে এসেছে। ওয়াদে আলফাইউমির মা হানান শাহিনের আইনজীবী ও নাগরিক অধিকারকর্মী বেন ক্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেন, এই রায় ন্যায়বিচারের একটি অংশমাত্র। ওয়াদে ছিল এক নিরপরাধ শিশু, যার জীবন বিদ্বেষের কারণে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ঘৃণার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।
ওয়াদে আলফাইউমির মা হানান শাহিন আদালতে তার সাক্ষ্য দেওয়ার সময় জানান, চুবা ক্রমাগত মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাবাদী মন্তব্য করতেন এবং তাকে গৃহত্যাগ করতে চাপ দিচ্ছিলেন। তার মতে, চুবা বলেছিলেন, তোমরা মুসলমানরা ইহুদিদের এবং শিশুদের হত্যা করছো। তিনি আরো জানান, হামলার আগে চুবা একবার তার ব্যাংক থেকে ১ হাজার ডলার উত্তোলন করেছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন যে, মার্কিন ব্যাংক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং বিশ্বযুদ্ধ আসছে।
কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (কেয়ার)-এর জাতীয় নির্বাহী পরিচালক নিহাদ আওয়াদ বলেন, এই ভয়ঙ্কর ঘটনায় ন্যায়বিচার হয়েছে, যেখানে মুসলিম ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিদ্বেষ এক নির্দোষ শিশুর বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী সহিংসতায় রূপ নেয়। তবে কোনো দোষী রায়ই ওয়াদেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এবং গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চালানো অপপ্রচার ও মানবিক অবমাননা ওয়াদে আলফাইউমির হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। ইসলামোফোবিয়া কেবল ঘৃণা ছড়ায় না, এটি প্রাণ কেড়ে নেয়। যারা ইসলামবিদ্বেষ, ফিলিস্তিনবিরোধী বর্ণবাদ এবং অন্যান্য সব ধরনের বিদ্বেষ প্রচার করেন, তারা যেন দেখেন, এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা কতটা ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
কেয়ারের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ রেহাব বলেন, এই বিদ্বেষের বিস্তারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দায়িত্বশীলতা আছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ভিত্তিহীনভাবে বলেছিলেন যে ৪০টি শিশু শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, তখন সেটি জোসেফ চুবার মতো ব্যক্তিদের আরো উগ্র করে তোলে। এই মিথ্যা দাবিগুলোই চুবার মতো মানুষের চরমপন্থী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। গণমাধ্যম কেবল সংঘাতের একপাশ দেখিয়েছে, কিন্তু গাজায় শিশু, নারী ও বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং অবর্ণনীয় কষ্টের বাস্তবতা তুলে ধরেনি। এই একপেশে বর্ণনার কারণে মুসলিম ও ফিলিস্তিনিদের মানবিকতা অস্বীকৃত হয়েছে, যা চুবার মতো মানুষকে হত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামোফোবিয়া উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ঘটনা ঘটছে, বিশেষ করে ইসরায়েল-গাজা সংঘর্ষের পর আরও তীব্র হয়েছে। একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনা এই সত্যের প্রমাণ, যেখানে মুসলিম এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্যরা অত্যন্ত সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে একটি সবচেয়ে হৃদয়বিদারক এবং শোকজনক ঘটনা ঘটেছে ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে, যেখানে ছয় বছর বয়সী ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিশু ওয়াদে আল ফায়ৌমি হত্যা করা হয়েছে, যা ইসলামবিদ্বেষী ঘৃণার দ্বারা চালিত। এ ঘটনাটি দেশের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষের এক ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পুরো জাতিকে আতঙ্কিত করে তোলে।
ওয়াদে আল ফায়ৌমির হত্যাকাণ্ড একটি অন্ধকার এবং দুঃখজনক দৃষ্টান্ত, যা আমাদের সমাজে বিদ্বেষের, ইসলামোফোবিয়া এবং ঘৃণার বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। মানবাধিকার এবং সমতার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের একত্রিত হতে হবে, যাতে এমন নিরপরাধ শিশুদের জীবন আর বিদ্বেষের শিকার না হয়। মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং ঘৃণার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে এবং এটি একমাত্র সম্ভব হবে যদি আমরা সমাজে মানবিকতা এবং সহমর্মিতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করি।
এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং হামলা যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মারাত্মক পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে। মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ কেবল সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, এটি মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। সন্ত্রাস, সহিংসতা ও ঘৃণার বিরুদ্ধে আমেরিকানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য সমান অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো নিরপরাধ শিশুর জীবন বিদ্বেষের কারণে নষ্ট না হয়। মুসলিম বিদ্বেষ ও ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে এবং আমাদের সমাজে ঘৃণা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করতে হবে। এটি একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন প্রশাসনসহ সব নাগরিক মানবতার পক্ষ নেবে এবং সব ধরনের বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেবে।