ছাত্রদের রাজনৈতিক দল নিয়ে অভ্যন্তরে কী চলছে


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 19-02-2025

ছাত্রদের রাজনৈতিক দল নিয়ে অভ্যন্তরে কী চলছে

আলোচনার টেবিল ছাড়িয়ে পক্ষ বিপক্ষের ক্ষোভ যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছড়িয়ে দেন নিজেরাই তখন আর বিষয়টা অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে থাকে না। ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে নিজেরাই এখন পক্ষ বিপক্ষ, তথা দ্বিধা বিভক্তি সামনে তুলে দিয়েছেন। সূচনাতেই সদস্য সচিবের এক পদ নিয়ে বিভক্তি সৃষ্টি হয়, তাহলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে এটা নিশ্চিত। 

নতুন দল গড়বে, সেখানে নতুন অনেক অতিথি আসার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছেন। অতিথি বলতে, যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বা কোনো পার্টও নয়। কিন্তু যেহেতু ছাত্ররা নতুন দল গঠন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখনই অতিথি পাখির আনাঘোনা শুরু। ছাত্ররা যে এদের নেবেন না তা-ও নয়। একটা রাজনৈতিক দলে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সংমিশ্রণ প্রয়োজন। সে সমন্বয়টাই তারা ঘটাতে চান। কিন্তু এসব অতিথিরা ছাত্রদের দলের টিকেট নিয়ে নির্বাচনও করতে পারবেন কি না সেটা ক্লিয়ার হওয়া যায়নি। তবে বেশ ক’জন অতিথির নাম ইতিমধ্যে শোনা গেছে, যারা উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন যোগ দিতে। প্রশ্ন উঠতে পারে কারা এরা? 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছাড়া আর সব দলের কর্মী বা সমর্থকদের সমন্বয় ছিল। স্বাভাবিকভাবে ছাত্রদের দলেও এমন একটা আমেজ বিরাজ করবে। অনেক বুঝেশুনেই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী দেশব্যাপী তাদের আসন প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। অথচ নির্বাচন হওয়ার দিনক্ষণ আরো এক বছর পর। কেননা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ডেডলাইন স্পষ্ট করেছেন, সেখানে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ হওয়ার কথা জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু এ তারিখও পেছানোর নানা প্রেক্ষাপট বিদ্যমান। 

ফলে এত আগে কে কোন আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেটা জামায়াত আগেভাগে চূড়ান্তকরণের রহস্য রয়েছে। তাছাড়া জামায়াত বরাবরই পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের পরই নির্বাচন দাবি করে আসছে। যার অর্থ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায় বললে ২০২৬-এর মাঝামাঝি হবে জাতীয় নির্বাচন। ইউনূস বলেছেন, যদি স্বল্প পরিসরের সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হয় তাহলে সেটা আগামী ডিসেম্বরের নাগাদ। আর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হতে হলে আরো প্রায় ৬ মাস সময়ের প্রয়োজন। ফলে এতো আগে জামায়াতের প্রার্থী চূড়ান্তকরণের নানা সমীকরণ রয়েছে। 

বিএনপি এক্ষেত্রে কিছুটা রয়ে সয়ে হাটছে। অবশ্য কে নির্বাচনের প্রার্থী হবেন কে হবেন না সেটা এখন লন্ডনের সিদ্ধান্তের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। ফলে অনেকেই রয়েছেন যারা বিএনপির এ দীর্ঘ আন্দোলন যাত্রায় আড়ালে ছিলেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে টিকে ছিলেন। এরা আবার বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। দলের আনুকূল্যতা লাভেরও আশায় রয়েছেন। তবে এদের অবস্থা দোদুল্যমান। দলীয় নীতিতেও এরা দোদুল্যমান। আদৌ এরা নমিনেশন পাবে কি না-এ নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায়। অনেকে নিশ্চিত তারা পাবেনও না। কারণ শুধু চুপ থাকা এক কথা। কেউ কেউ দল ভাঙ্গারও চেষ্টা করেছিলেন বলে নানা সময়ে অভিযোগ উঠেছে। ফলে তাদের সম্ভাবনা নেই। এরা এখন ছাত্রদের দলে অন্তর্ভুক্তির নানা চেষ্টা তদবির চালাচ্ছে। কারণ এখানে মনোনয়ন পাওয়া সহজ। আর বয়সের কারণে সেটা সম্ভব না হলেও ভালো একটা পদপদবি পেতেও পারেন। কারণ আগামীতে ছাত্রদের দলই প্রভাব বিস্তার করবে যদি তারা সরকার গঠনের মতো ফলাফল না-ও পায়, তবু, এটা অনেকটাই নিশ্চিত। শুধু বিএনপি, জামায়াত নয়, জাতীয় পার্টি এমনকি আওয়ামীপন্থীরাও অর্থের ঝনঝনানি নিয়ে তৈরি ও সুযোগের অপেক্ষায়। 

ফলে এদের কিছু কূটকৌশল বা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্রদের নতুন পার্টির নীতিনির্ধারণীতে পছন্দের লোক বসানোর কলকাঠি নাড়বেন না-এটা হয় কি করে!

তবে এটা ছাত্রদের দলের জন্য খুবই দুঃখজনক ঘটনা যে নতুন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদ নিয়ে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তরুণ ও শিক্ষার্থীরা। এর মাধ্যমে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বাদ পড়ছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। দলের কমিটিতে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম শীর্ষপদে থাকার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হলেও সদস্যসচিব পদে পাঁচজন আলোচনায় রয়েছেন।

গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে আখতারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে অনেকে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে বেশি সরব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রুপগুলোয় সারারাত রীতিমতো চর্চার বিষয় ছিল ইস্যুটি।

অনেকে বলছেন, আখতার শুধু চব্বিশের অভ্যুত্থান থেকে নয়, বরং ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন। ফলে আখতারের গ্রহণযোগ্যতা যেখানে সর্বাগ্রে সেখানে কেউ কেউ আখতারকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য উপায় নিয়ে ব্যস্ত। 

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঘোষণা হতে যাওয়া নতুন দলে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রধান হচ্ছেন বলে অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে তিনি উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দলের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। ফলে দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড কে হবেন, সেটা নিয়েই চলছে আলোচনা। এত এগিয়ে আছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, যুগ্ম-আহ্বায়ক আলী আহসান জুনাইদ, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।

জানা গেছে, আখতারকে চাচ্ছেন তরুণদের একটি অংশ। তারা গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আখতারের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম, আন্দোলনে গ্রেফতার ও ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা করছেন।

এ প্লাটফর্মের শীর্ষ এক নেতা বলেন, নতুন রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করে ছাত্রনেতাদের মধ্যে তিনটি কোরাম হয়েছে। একটি বামধারা থেকে আসা ছাত্রনেতাদের, দ্বিতীয়টি সাবেক শিবির নেতাদের এবং তৃতীয়টি মোটাদাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, যাদের মূল ছাত্র অধিকার পরিষদ কিংবা ছাত্রশক্তি।

আলী আহসান ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি। গুঞ্জন উঠেছে, নতুন দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডে তাকে আনার চেষ্টা করছেন জামায়াতপন্থীরা। আখতার উপদেষ্টা হওয়ারই কথা ছিল এমন গুঞ্জন আগ থেকেই বিদ্যমান। কিন্তু তাকে করা হয়নি। নতুন রাজনৈতিক দল ইনক্লুসিভ করতে গিয়ে এখানে নানান মতের মানুষ আসছে। শিবির চায় তাদের সাবেক নেতারা নেতৃত্বে আসুক। বামরা প্রথমে আখতারের দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য তাকে নেতা হিসেবে চেয়েও এখন চায় না। 

ছাত্রশক্তি থেকেও আখতারকে চায় না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না। তবে যে যাই বলুক, মাহফুজ এখানকার ব্রেইন। নাহিদ প্রধান হোক। কিন্তু আখতারকে সেকেন্ড ইন কমান্ডে না রাখলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। তার প্রতি অন্যায় হবে-এমন অভিমত অনেকের। 

অ্যাকটিভিস্ট আব্দুল্লাহ হিল বাকি এ বিষয়ে ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আখতার হোসেনের কোনো ভূমিকা নেই! ১৭ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রথম পুলিশি ক্র্যাকডাউনের মূল টার্গেটই ছিল তাকে আটক করা। সাহসী উচ্চারণে সেদিন স্ফুলিঙ্গ ফুটেছিল চারদিক। যেটা রয়টার্স কাভার করেছিল সেদিন।’

অন্য একটি পোস্টে তিনি লেখেন, আখতার হোসেনদের লড়াই শুধু জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে নয়, বরং ঢাবির প্রশ্নফাঁস আন্দোলন থেকে শুরু, যার ধারাবাহিকতায় ডাকসুসহ সব আন্দোলনে মূল ফোকাস পয়েন্টেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ তার ফেসবুকে লিখেন, ‘আমার ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতিতে আসা আখতার হোসেনের হাত ধরেই। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ওনার ভালোবাসা সব সময় আমাদের মুগ্ধ করেছে। ঢাবি ক্যাম্পাসে একক নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সব সময় রুখে দাঁড়িয়েছেন। কোনো যদি-কিন্তু ছাড়া সচেতন নাগরিক হিসেবে আখতার হোসেনের পাশে আছি। কাউরে নিয়া ষড়যন্ত্র কইরেন না।’ 


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)