বাংলাদেশের স্মার্ট এনার্জি ট্রান্সিশন চ্যালেঞ্জ


সালেক সুফী , আপডেট করা হয়েছে : 19-02-2025

বাংলাদেশের স্মার্ট এনার্জি ট্রান্সিশন চ্যালেঞ্জ

জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ সঙ্কটের অব্যাহত ধারায় বাংলাদেশের এখন অন্যতম প্রধান সমস্যা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চৌকষ জ্বালানি রূপান্তর- পরিবেশ দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়ণযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যানো পরিবেশ দূষণকারী উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় খুব একটা পরিবেশ দূষণ করে না। কিন্তু বৈষয়িক দূষণের অন্যতম প্রধান শিকার বাংলাদেশ। প্রতিবছর অতি বৃষ্টি, প্লাবনে ভেসে যায় ক্ষেতের ফসল, অনাবৃষ্টির কারণে এবং প্রতিবেশী দেশ উৎসে নদ নদীর পানি অযাচিতভাবে অন্যত্র প্রভাবিত করায় মরু সৃষ্টির উপক্রম দেশের বিশাল এলাকা। নিজেরা দুষণ কম করলেও নানা কারণে বাংলাদেশের বাতাস মারাত্মকভাবে দূষিত। নদী, খাল, বিল, জলাশয়ও মারাত্মকভাবে দূষিত। 

ভুল কৌশলের কারণে বাংলাদেশ নিজেদের জ্বালানি সম্পদ যথা প্রয়োজন যথা সময়ে উত্তোলন করতে ব্যর্থ হয়ে ক্রমাগত বিক্ষুব্ধ বিশ্ব বাজার থেকে জ্বালানি আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সেখানেও চ্যালেঞ্জ প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাব। অথচ বাংলাদেশ জীবাস্ম জ্বালানি থেকে নবায়ণযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০৫০’র মধ্যে নেট জিরো অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ এনডিসি ঘোষণা দিয়েছে। প্রাথমিক ঘোষিত ইনডিসি পরিবর্তন করে সময়পোযোগী করেছে। সবাই জানে এখনো বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার প্রধান জ্বালানি উৎস নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস এবং আমদানিকৃত এলএনজি। পাশাপাশি অন্যতম প্রধান বিকল্প হিসাবে কয়লাকে বেছে নেয়া হলেও নীতিনির্ধারকদের দোদুল্যমন্যতার কারণে বিপুল পরিমাণ উন্নত মানের কয়লা সম্পদ মাটির নিচে পড়ে আছে। 

সাগর উপকূলে কয়েকটি স্থানে আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কয়েকটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানেও একমাত্র মাতারবাড়ি ছাড়া অন্য সব প্লান্টের ক্ষেত্রে কয়লা পরিবহনে সমস্যা আছে। আছে অর্থের সংকট। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরিবহনের জ্বালানির একটি প্রধান অংশ তরল পেট্রোলিয়াম জ্বালানিনির্ভর। কিন্তু ফার্নেস অয়েল বা ডিজেল প্রধান পরিবেশ দূষণকারী জ্বালানি। এখান থেকে বাংলাদেশকে দ্রুত সরে আসতেই হবে, বিকল্প আছে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ এবং পরিছন্ন জ্বালানিনির্ভরতা বাড়ানো। সবাই বিষয়টি জানে বুঝে। কিন্তু নবায়ণযোগ্য জ্বালানি প্রসারে নানা বাধা বিপত্তির কারণে বিকাশ দ্রুততা পাচ্ছে না। আঞ্চলিক জ্বালানি সহযোগিতার কথা জোরে সোরে বলা হলেও বাস্তব অর্জন সীমিত প্রতিবেশী দেশের অসহযোগিতার কারণে।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তর বিশাল বাধায় বাধাগ্রস্ত। বাংলাদেশের সমন্বিত জ্বালানি বিদ্যুৎ পরিকল্পনা এখন পরিবর্তন এবং সময় উপযোগী করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে, নবায়ণযোগ্য জ্বালানি পরিকল্পনা সময়পোযোগী করার জন্য একটি খসড়া প্রস্তুত করে আগ্রহীদের মতামত চাওয়া হয়েছে। এখানে প্রধান বাধা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি ভঙ্গির। নবায়ণযোগ্য জ্বালানি অবদান বৃদ্ধির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একটি চ্যাম্পিয়ন প্রতিষ্ঠান। স্রেডা বর্তমান অবস্থায় নীতি প্রণয়ন এবং ক্ষেত্র বিশেষে রেগুলেটর ভূমিকা পালন করেছে। এই কাজে সম্পৃত্ততা আছে পরিবেশ অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং তার অধীন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো, আছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট।

উদ্যোক্তাদের এই খাতে বিনিয়োগ করতে হলে বিভিন্ন সংস্থার কাছে অনুমোদনের জন্য ছোটাছুটি করতে হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সময় অর্থের অপচয় হয়, তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটাতে হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন পেট্রোবাংলা বা পিডিবির মত একটি সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ান পয়েন্ট সার্ভিস নিশ্চিত করা। 

অনেকেই বলেন ইউটিলিটি সোলার স্থাপনের জন্য বাংলাদেশে জমি সংকট। প্রকৃত পক্ষে জমির যতটা সংকট তার চেয়েও বেশি সমস্যা জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘ সূত্রিতা। সরকার যেভাবে ফসিল ফুয়েলনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে আইপিপির আওতায় জমি অধিগ্রহণ করে উন্নয়নের পর ল্যান্ড দিয়েছে সেটি করলে এবং সরকারি খরচে গ্রিড সংযুক্তির ব্যবস্থা করলে ৫-৬ বছরের মধ্যে ইউটিলিটি সোলার থেকে বড় অর্জন সম্ভব। সেই ক্ষেত্রে বিদ্যমান অবস্থার বিপিডিবিকে একক বিদ্যুৎ ক্রয়কারী সংস্থা মডেল পরিবর্তন করে কর্পোরেট পিপিএ মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিক্রি উন্মুক্ত করে দেয়া এখন সময়ের দাবি। 

এরপর আসুন শিল্প কারখানা, সরকারি আধা সরকারি এবং স্বায়ত্ব শাসিত প্রসতিস্থানসমূহের ছাদে সৌর বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন এবং নেট মিটারিংয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ গ্রীডে সঞ্চালন। এখানেও কিছু কারিগরি সমস্যা, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখানে বিনিয়োগে প্রধান বাধা ইডকল এবং স্থানীয় ব্যাঙ্কগুলোর বিনিয়োগ সহযোগিতার সমস্যাগুলো। সমস্যাগুলো চিহ্নিত হলেও সমাধানের আন্তরিকতা অনুপস্থিত, ওপেক্স মডেল অনুসরণ করে সীমিত সাফল্য আসলেও বিনিয়োগ বাধার কারণে উন্নয়নের গতি সীমিত। অথচ এই ক্ষেত্রে প্রণোদনা পেলে ৫ বছরের মধ্যে শুধু রুফ টপ সোলার থেকে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সেই ক্ষেত্রে সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাবহৃত প্যানেল, ইনভার্টার, ব্যাটারি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক নিদেনপক্ষে ৫ বছরের জন্য শুণ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। 

এই সময়ের মধ্যে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দেশের অভ্যন্তরে সোলার বিদ্যুৎ উপকরণ তৈরির কারখানা স্থাপন করতে পারে। 

আমি দেশে ভাসমান সোলার, হাইব্রিড সোলার (সোলার বিদ্যুৎ+মাইক্রো টার্বাইন) স্থাপন, সোলার ইর্রিগেশনের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাই। বিশেষত সরকার সোলার ইর্রিগেশনের জন্য একটি বিজনেস মডেল তৈরি করলে এই খাতে বিনিয়োগ আসবে। তবে মনে রাখতে হবে সোলার বিদ্যুতে ব্যাটারি সংযুক্ত করতেই হবে, এখন কিন্তু ব্যাটারি প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। খরচ কমে এসেছে। 

অনেকের ভুল ধারণা বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা সীমিত। উপকূল অঞ্চল, গভীর সাগর, দ্বীপাঞ্চলে সম্ভাবনার কথা নানা সমীক্ষায় দেখেছি। অফশোর উইন্ড ব্যবহার করে সাগর জল থেকে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন করা যেতে পারে। বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা এনার্জি ট্রান্সিশনকে অনেকটা সহায়তা করবে। অস্ট্রেলিয়া সহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে কাজ হচ্ছে। 

এই ব্যবস্থাসমূহ নবায়ণযোগ্য জ্বালানি পলিসিতে থাকতে হবে এবং একটি সঙ্গে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য একটি চ্যাম্পিয়ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে যথাযথ পেশাদারদের দায়িত্ব দেয়া হলে ২০৩০’র মধ্যে ১০% এবং ২০৪১ মধ্যে ৩০% বিদ্যুৎ নবায়ণযোগ্য জ্বালানি থেকে যোগান দেয়া কঠিন কিছু হবে না। প্রবাসী অভিজ্ঞ বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সুযোগ।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)