আগে সংস্কার এবং এর পরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন- এমন দাবিতে সোচ্চার হলেও নিজেরাই গোপনে ঠিকই মাঠে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে জামায়াতে ইসলামী। বিভিন্ন স্থানে প্রার্থী বাছাই করে আগে ভাগেই প্রস্তুত করে ফেলেছে নির্বাচনী মাঠ। সংস্কারের দাবির আড়ালে যে দলটি সারাদেশে একপ্রকার নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে আছে তা ধীরে ধীরে স্পস্ট হয়ে উঠছে। এধরনের কৌশলকে রাজনৈতিক মহল রাজনীতিতে জামায়াতের দ্যুতিয়ালী মনে করছে। তারা মনে করছে, জামায়াত আসলে কখনো প্রকাশ্যে স্বচ্ছভাবে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারছে না বা পারেই না।
গোপনে নির্বাচন প্রস্তুতি জামায়াতের
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বড়ো ধরনের দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের আওয়াজ তুলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্বাসী বিএনপির সাথে সরাসরি বিরোধে নামে দলটি। দলের পক্ষ থেকে যতোবারই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের সাথে বৈঠক করেছে ততবারই দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের আওয়াজ তুলেছে। এনিয়ে বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব দিনের পর পর বাড়তেই থাকে। এসবের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ নিয়েও দেশের অনেক স্থানে বেশ কয়েকবারই বিএনপি-জামায়াত মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়।
জামায়াতে একেক জনের মুখে কথা
এদিকে নির্বাচন না আগে সংস্কার এমন ইস্যুতে জামায়াতের একেকজন একেক রকম বক্তব্যও দিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দলটির একেক নেতা নির্বাচন নিয়ে একেক রকম বক্তব্য বিবৃতি দেন। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে সেটা হবে নির্বাচনের গণহত্যা। এটা কোনো নির্বাচন হবে না। জামায়াতে ইসলামী সেটা চায় না। নির্বাচনের আগে কিছু মৌলিক সংস্কার হতেই হবে। দেশে একটি গণহত্যা হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিস্থিতি তৈরি হতে হবে। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন আগে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন অন্য কথা। তিনি বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে নানা ধূম্রজাল সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা পরিষ্কার করতে চাই, সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে যারা প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন তারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার সত্যিকারের হকদার। সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার কখনই জনগণের সরকার না। এজন্য নানান অজুহাতে নির্বাচনকে বিলম্ব করার চেষ্টা দেশবিরোধী ও ৫ আগস্টের চেতনাবিরোধী।
গোপনে গোপনে যা যা করলো জামায়াত
এখনই বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে সেটা হবে নির্বাচনের গণহত্যা-এমন বক্তব্য দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে আসলে-ও ভেতরে চলছে অন্য প্রক্রিয়া। সূত্র জানায়, তিনশত আসনেই জামায়াত তার প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। এমনকি তাদের সমমনা বলে পরিচিত ইসলামী দলগুলি নিয়ে জামায়াত যে নির্বাচনী জোট করার কথা বলেছে তাদের-কেও নিজেদের এমন প্রস্তুতির কথা গোপন রেখেছে দলটি। বরং এমন একটা ভাব জামায়াতের মধ্য থেকে দেখানো হচ্ছে যে, তারা পর্যাপ্ত বা বলা চলে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার ছাড়া নির্বাচনেই অংশ নেবে না। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে যে, দলটি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের পাঁচটি আসনের মধ্যে চারটির প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। একটি গণমাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও মহানগরের সদর থানার আমির অধ্যক্ষ সালাহউদ্দিন আইউবী। অপরদিকে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিলেট বিভাগের চার জেলার ১৯টি সংসদীয় আসনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে দলটি ‘নির্বাচনী মাঠে’ও নেমেছে দলটি। অপরদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়ার চারটি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। অপরদিকে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য খুলনার ছয়টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে দলটি।
অবশেষে মুখ খুললো জামায়াত
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আসলে তলে তলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে-এমন খবর চাওড় হয়ে গেলে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। জামায়াত এখনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করেনি উল্লেখ করে শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জামায়াত এখনো অফিশিয়ালি প্রার্থী ঘোষণা করেনি, এটা প্রাথমিক সিলেকশন। এক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিস্কার জামায়াত কিন্তু নির্বাচনের দিকেই হাটছে সংস্কার বলে শুধু বুলি আওড়াচ্ছে।
অতীত ফিরে দেখা ও শেষ কথা
বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন দিলে সেটা হবে নির্বাচনের গণহত্যা। এটা কোনো নির্বাচন হবে না-এমন ভঙ্গিতে কথা বলে নিজেদের দ্রুত নির্বাচন হবে বলে তৈরি করে রাখা হয়তবা দলটির কৌশল বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। বর্তমান প্রজন্ম এমন দ্যুতিয়ালী অস্বচ্ছ রাজনীতি যে পছন্দ করে না তা ফ্যাসিবাদী পতন আন্দোলনে টের পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি একজন নেতা দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, জামায়াতের এমন দ্যুতিয়ালী রাজনীতি অতীতেও দেখা গেছে। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে যখন যা প্রয়োজন তা-ই করবে, দেশ নিয়ে ভাবার টাইম নেই। প্রয়োজনে কোনো দলের ভেতরে দিনের পর দিন বছরের পর বছর ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। আর ফায়দা নিয়ে সটকে পরে।
ভবিষ্যতে তারা এমনটি যে আর করবে না তা বলা যায় না। বিএনপি’র আরেক নেতা বলেন, ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা বসে। তিনি নির্বাচনের টোপ দিলে মুখে না বললেও কিভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়া যায় সে ফর্মূলা বাতলিয়ে দেন ১৯৮৩ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ চত্বরে এক জনসভায় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান। তিনি ‘কেয়ারটেকার সরকার’-এর অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তোলেন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলের জোট। আর বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলের জোট । অন্যদিকে জামায়াত অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করতে থাকে।
কিন্তু ১৯৮৬ সালে যখন সংসদ নির্বাচন হয়, তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। তার সঙ্গী হয় ১৫ দলের জোট থেকে বেরিয়ে আসা ৫টি বাম দল। আওয়ামী লীগ তার সমমনাদের নিয়ে এই নির্বাচনে যায়,এতে সাথী হয় জামায়াত। ওই নির্বাচনে জামায়াত স্বাধীন বাংলাদেশে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক নিয়ে প্রথমবার নির্বাচন করে ১০টি আসন পায়। এতে করে এরশাদের সামরিক শাসন বৈধ হয়। আর অন্যদিকে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে যায় জামায়াত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সদস্যরা এক ছাদের নিচে বসে আইন তৈরির ছাড়পত্র পান। তার পর থেকে তাঁরা দীর্ঘদিন একসঙ্গেই পথ চলে। ১৯৮৮ সাল থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জোয়ার আসে। তখন সবাই মিলেঝুলে ‘যুগপৎ’ আন্দোলন করে অতীত কর্মকাণ্ড মুছে দেয়ার চেষ্টা করে। আর এভাবে জামায়াত যুগের পর যুগ দুতিয়ালী অস্বচ্ছ রাজনীতি করে আসছে বলে তার অভিমত।