জামায়াতের আচমকা পিছুটান


সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ , আপডেট করা হয়েছে : 04-12-2024

জামায়াতের আচমকা পিছুটান

এবার জাতীয় ঐক্যের কথা বললো জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নেতারা। এমনকি কি দলটি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ঐক্য তৈরির ব্যাপারে বিএনপি যে দাবি জানিয়েছিল, তার সঙ্গে একমতও পোষণ করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এনিয়ে নানান ধরনের গুঞ্জন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এভাবে হঠ্যাৎ করে বিএনপি’র ডাকে ঐক্যে সাড়া দেয়া কি জামায়াতে ইসলামী’র জন্য এটা একধরনের পিছুটান। এভাবে বিএনপি’র ডাকে সাড়া দিয়ে কি দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের দাবি থেকেও জামায়াত সরে আসলো? প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কিন্তু কেনো? এবিষয়গুলি যে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে তা মাঠ পর্যবেক্ষণে জানা গেছে। 

সংস্কার নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্ব

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছিল চলতি বছরের ৫ আগস্ট। এরপর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই প্রথম দফায় বিএনপি’র নেতারা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করেন, যা ছিল অনেকটা শুভেচ্ছা বিনিময়ের মতোই। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে বিএনপি যৌক্তিক সংস্কারের দাবি ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করে দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কারের ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর দাবি জানাতে থাকে, বলা যায় মাঠ গরম করতে থাকে। জামায়াতের এমন আচরণকে বিএনপি ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখে। তারা এর পরেই অক্টোবরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপি আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে বসে। কিন্তু সে-বৈঠকেও জামায়াত গুরুত্ব দিয়েছে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারে। প্রধান উপদেষ্টার সাথে আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপে আমরা সরকারের কাছে কোনও মাস দিনকাল নিয়ে কথা বলিনি। অপরদিকে সংলাপ শেষে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, “আমাদের দেওয়া দু’টি রোডম্যাপের মধ্যে একটি হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলেই নির্বাচন সফল হবে।” জামায়াতের সাথে সংস্কার নিয়ে বিএনপি’র সাধে মতভেদ যখন চরমে ঠিক সসময়ে সর্বশেষ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। তার সে ভাষণে নির্বাচনের রূপরেখা না থাকার অভিযোগ আনেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতারা। এনিয়ে হতাশা প্রকাশ করে আশাহত হওয়ার কথা বলেন তারা। কিন্তু এর বিপরীতে প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী জামায়াতে ইসলামী ঠিকই সংস্কারে জোর দেয়। আশাবাদও ব্যক্ত করেন দলের নেতারা।

হঠাৎ ঐক্যের ডাক

বিএনপি’র সাথে জামায়াতের এমন মতভেদ চরমে পৌঁছালে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। বিশেষ করে ইসকন ইস্যু ও দেশে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগ দেশে বিদেশে উচ্চারিত হতে থাকে । এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে দেশ এক রহস্যময় অবস্থা বিরাজ করে। ইসকন প্রসঙ্গ ছাড়াও চট্টগ্রামে আইনজীবীকে হত্যার বিষয়ে কয়েক দিনের নৈরাজ্যে উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনমনে নানান ধরর্নে শঙ্কা বিরাজ করে। এমন পরিস্থিতিতে গত ২৭ নভেম্বর বুধবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সাক্ষাৎ করেন। বিভিন্ন স্থানে সংঘাত, হানাহানিসহ দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিএনপি’র নেতারা। দলটি নেতারা বিভাজনের পথ এড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির কথা বলেছেন। অন্যদিকে বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতে, বিশেষ করে কয়েক দিন ধরে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ছাত্রদের সমস্যা-এগুলো নিয়ে দলের পক্ষ থেকে আমরা উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। এসব বিষয়ে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছি। সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার কথাও বলেছি। আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর পরিষদ নিয়ে অতি দ্রুত উদ্ভূত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যবস্থা করবেন।’

এর পরের দিনই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ঐক্য তৈরির ব্যাপারে বিএনপি যে দাবি জানিয়েছে, তার সঙ্গে একমত পোষণ করে ঘোষণা দিয়েই জানান দেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। গত ২৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। জামায়াতের আমীর আরো জানান, অন্তর্বর্তী সরকার যাতে শৃঙ্খলার ভেতর থেকে একটা কার্যকর নির্বাচনের দিকে আগাতে পারে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশ আমাদের সবার, জাতি, ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে জাতীয় ঐক্য গড়া, যাতে আরও শক্ত বা দৃঢ় থাকা যায়। এছাড়া প্রশাসনে আরও কিভাবে গতি আনা যায়, এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানান। জামায়াতের আমীর বলেন, এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিএনপির ঐক্য তৈরির দাবিকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি।

ঐক্যে জামায়াতের সাড়া দেয়ার নেপথ্যে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সংস্কারের প্রশ্নে বিএনপি’র সাথে জামায়াতে ইসলামী দ্বন্ধ প্রকট হয়ে উঠে। কিন্তু সেই মতভেদের সুরাহা না হতেই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ঐক্য তৈরির ব্যাপারে বিএনপি যে দাবি জানিয়েছিল, তার সঙ্গে আচমকা একমত পোষণকে কেউ কেউ জামায়াতের একধরনের পিছুটান হিসাবেই দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল। কিন্তু কি কারণে? কেনো জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে বিএনপি’র সাথে সহমত পোষণ করলো জামায়াত? এটা কি একলা চলা থেকে জামায়াতে ইসলামী পিছু হটা? না-কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলটি’র বিরুদ্ধে উগ্র মৌলবাদী ট্যাগটি সরাতে ব্যর্থ হয়েছে? নাকি প্রতিবেশী একটি দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে আরেক দফা ব্যর্থ হয়েছে? দরকষাকষিতে হিসাব মেলেনি? আস্থায় নিতে পারেনি তাদের? তাদের থেকে গ্রীন সিগনাল না পেয়েই কি বিএনপি’র ঐক্যের ডাকে সাড়া দিলো জামায়াত? জামায়াত যে তা অর্জন করতে পারেনি তা সম্প্রতি পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের মন্তব্যে বুঝা যায়। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় ভারতীয় গণমাধ্যম খুবই অখুশি বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয় গণমাধ্যম প্রমাণ করতে চাচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে এবং তালেবান ঘরানার সরকার আসতে যাচ্ছে। এতে বোঝা যায় যে এধরনের অভিযোগে দায় বর্তায় জামায়াতেরই ওপর। তাই এখন এমন প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে এসব ঠেকাতে বিএনপি’র সাথে মিশে দলটি নিজেদের উদার গণতান্ত্রিক দল হিসাবে প্রচার কারতে চায়। আবার কারো কারো মতে, আমেরকিার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশে এক অন্য ধরনের বাতাস বইছে। ধারণা করা হচ্ছে যে ট্রাম্পের বিজয়ে বিএনপি যতোটা না বেকায়দায় পড়বে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পড়তে পারে জামায়াত। তা-ই দলটি একলা চলো নীতির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার নিয়ে এখন মাতামাতি করতে চায় না। সূত্র জানায়, এসব কারণেও জামায়াতের পিছুটান। অন্যদিকে জামায়াতের সাথে মাঠে বিএনপির বিভিন্ন সংগঠনের সাথেও প্রতিদিন দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই আছে। বিএনপি’র নেতাকর্মীদের অভিযোগ নানান ধরনের ছল-চাতুরি করে জামায়াত তাদের (বিএনপি) সমর্থিত সব ধরনের পেশাজীবী সব ধরনের সংগঠনে ঢুকে পড়ছে। এসব নিয়ে বিএনপি’র হাই কমান্ড প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ এবং তারা মারমুখী অবস্থানে। জানা গেছে এসব বিষয়গুলি জামায়াতের হাই কমান্ডের মাথায় আছে। তাই হঠাৎ দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সুযোগে যদি কোনো ধরনের অঘটন ঘটে যায় সেক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে জামায়াতের নেতাকর্মীরাই পড়বে। আর সেদিকে যেনো না যেতে হয় তাই তড়িঘড়ি বিএনপির যাকে আপাতত ঐক্যের যাকে সাড়া দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে দলটি।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)