বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের ঐতিহ্যের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বহুত পুরানো। দলটিতে যেমন তুখোড় রাজনীতিবিদ রয়েছেন, তেমনি অভিজ্ঞ ও তারুণ্যেরও সংমিশ্রন বিদ্যমান। ৫ আগস্টের পর পর্দার আড়ালে দলটি বটে। তার মানে এই নয়, আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু এমন একটি দলের মাথা থেকে এখনও যেসব উদ্ভট চিন্তা বের হচ্ছে তাতে দীর্ঘ ১৬ বছর একচেটিয়া স্বৈরাতন্ত্র বিদ্যমান রেখে যে কাজগুলো করেছিল, তা থেকে তারা গত তিন মাসেও শিক্ষা নেয়নি সেটারই বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে না এটা কেউ বলেনি। নিষিদ্ধকরণের কথা উঠলেও তাদের সবচে বড় শত্রু বিএনপিই সর্বপ্রথম বাধা দিয়েছে প্রকাশ্যে। আর এ জন্যই অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা সামান্যও যেটুকু ভেবেছিল- তা থেকে সরে গেছে। কিন্তু খোদ আওয়ামী লীগের কর্মীদের অনেকেই বলছেন এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে আওয়ামী লীগ পেলে ঠিকই নিষিদ্ধ করণে মোটেও পিছপা হতো না আওয়ামী লীগ!
এটা ভিন্ন এক প্রসঙ্গ
কথা হচ্ছিল- কোন চিন্তাভাবনাতে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলটিতে হাইব্রিড নেতাকর্মীদের ভিড় জমেছিল এ কথা দলের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের মুখে মুখে আলোচিত ছিল। শেখ হাসিনা নিজেও বলেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে পারেনি কখনও। এমনকি দলের প্রান্তিক পর্যায়ে দীর্ঘ নিবেদিত ও আওয়ামী লীগে অন্ধ যেসব নেতাকর্মী তাদেরও পথে ঘাটে ভৎর্সনার শিকার হতে হয়েছে বহু। নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ থেকে অভিমানে ক্ষোভে কষ্টে।
এসব নেতাকর্মী এখন আবার সরব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করা যায় এ ব্যাপারে তাদের চিন্তার অভাব নেই। চেষ্টাও করছেন যে যার অবস্থান থেকে দলকে জাগিয়ে তোলার। কিন্তু এরই মধ্যে যে কর্মসূচিটা দেয়া হয়েছিল ১০ নভেম্বরকে ঘিরে- এটা কী সুষ্ঠু মাথার কোনো পরিকল্পনা ছিল? এ প্রশ্ন আওয়ামী লীগের মুখে মুখে।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। এটা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেরাও জানে। এ সময় চুপ থাকাই তারা শ্রেয় মনে করছেন যতদিন না সাধারণ মানুষ বলতে শুরু করবে আওয়ামী লীগের প্রয়োজনীয়তা শুরু হচ্ছে ওই অব্দি। তেমন এক মুহূর্তে জোর করে মানুষের ঘাড়ে চড়ে বসার মত কর্মসূচি দিয়ে কী হাসিল করতে চেয়েছিল দলটির নেতাকর্মী এ প্রশ্ন জনমনে।
মাঠে এখনও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা সরব। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যারা এখনও কোনো প্রতিশোধ নিতে পারেনি বা সুযোগ পায়নি। দু’চারটি যে হামলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর বাড়িতে হয়েছে সেটা ওই এলাকার দ্বন্দ্বের ফসল। ১৬ বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা শহর থেকে শুরু করে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ধোয়া তুলসিপাতা ছিল এটা ভুলেও বলবেন না। তাহলে সেখানে সামান্য হামলা হবে এটা স্বাভাবিক। অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্যাচার। তাও ওবায়দুল কাদের যেমনটা বলেছিলেন ক্ষমতা হারানোর পরের রাতে দশ লাখ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর লাশ পড়বে তেমন কিছু তো আর ঘটেনি। তাহলে আড়ালে আবডালে থাকা তৃণমূলের সে সব নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের ঘর থেকে টেনে বের করে জমের মুখে দাড় করানোর ফন্দিটা কে দিল?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে শোনা গেছে প্লান পরিকল্পনা দিতে। সে অনুপাতেই ১০ নভেম্বর ঘিরে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকেই সরবও হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার পর্যন্ত সারা দেশে বিজেপি মোতায়েন, ছাত্র জনতা বিভিন্ন স্পট বিশেষ করে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট আগের রাত থেকে দখল করে রাখে।
এটাকে রুখে দেয়া গেছে বলে ছাত্র জনতা উল্লাস করেছে। এবং শপথ নিয়েছে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দোসরদের এভাবেই রুখে দেবে। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো। কে লাভবান হলো এমন কর্মসূচি থেকে।
এ কর্মসূচির মাধ্যমে একটা নতুন কনসেপ্ট ক্রিয়েট হয়েছে যেটা আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৬ বছর প্রয়োগ করে গেছেন। বিএনপি বা জামাতের কোনো নেতাকর্মীকে আটক করতে চাইলে বা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিতে রাস্তায় নাশকতা এড়াতে পাহারা বসাতেন। এবং সন্দেহভাজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হতো- সেটা আগের রাত থেকে বাড়ি বাড়ি বা বাসায় বাসায় যেয়ে ধরে এনেও। রাস্তায় পেলেও তাকে আটক করা হতো।
১০ নভেম্বর কর্মসূচিতেও কোনো সন্দেহভাজন আওয়ামী লীগ বা তার কাছে আওয়ামী লীগের কোনো চিহ্ন পেলেও তাকে আটক করার মত কার্যাদি দেখা গেছে। যদিও সেটা ব্যাপক না। কারণ কোনো আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী মাঠেই নামেনি। অবুঝ জাতীয় কিছু নেতাকর্মী চেষ্টা করেছিলেন তারা ধরা খেয়েছে। সাধারণ মানুষই ধরিয়ে দিয়েছে।
ফলে ওই কর্মসূচি একটা বিষয় স্ট্যাবলিশ করে দিয়ে গেছে যে এখন থেকে সন্দেহভাজন কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে পেলে নাশকতা করতে পারে এমন অজুহাতে মানুষ আটক করে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করবে।
অর্থাৎ আওয়ামী লীগের উর্বর মস্তিস্কের যে প্লান সেটাতে দলের নীরিহ নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে বা তাদের অবস্থানস্থলটাকে অস্বস্তিকর করে দিয়েছে।
এ কর্মসূচিতে আরে একটা বিষয় ক্লিয়ার করেছে যে আগে কোনো প্রগ্রাম হওয়া মানেই হাজার হাজার আওয়ামী নেতাকর্মী মাঠে নেমে যেতেন। এখন দলের সভানেত্রীর নির্দেশনাতেও তারা মাঠে নামেনি। তারা জেনেশুনে নিজেদেরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাননি। কারণ দলের সভানেত্রী বা প্রধান ক্ষমতা ছেড়ে যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় লক্ষ লক্ষ নেতকর্মী রেখে। এমনকি তার পরবর্তি নেতারাও লাপাত্তা। তখন সাধারণ মানুষ যাদের বেশিরভাগ ১৬ বছরে কোনো সুফল নেননি তারা কোথায় গিয়ে ঠাঁই নেবেন। তাদের জন্য তো কোনো নির্দেশনা দিয়ে যাননি বা কখনও দেনও নি দলীয় প্রধান। ফলে একরকম অভিমানও তাদের মধ্যে।
১০ নভেম্বরের কর্মসূচির মাধ্যমে ওই সকল নেতাকর্মীরা মাঠে না নেমে নেত্রীর নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে একরকম নিজেদের ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। সার্বিকভাবে এমন কর্মসূচি দলগতভাবে আওয়ামী লীগকে আরেকবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বৈকি! এটা সত্য আওয়ামী লীগ মানেই সবাই খারাপ বিষয়টা এমন নয়। দলটিতে বহু নিবেদিত প্রাণ কর্মী নেতাও রয়েছেন। হাইব্রিডদের জন্য তারা আড়ালে চলে গেছেন। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে দাঁড়াতে হলে এসব নেতা কর্মীদের উপরই ভর করতে হবে। সকল সুবিধা নেয়া হাইব্রিডরা এড়িয়ে যাবে এটা দলের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধরকগণও জানেন। এরপরও তাদেরকে মাঠে নামিয়ে তাদের রক্ত ঝড়িয়ে, কুরবানী দেয়ার কী শখ জেগেছিল সেটা বোধগম্য না হলেও ট্রাম্পের হাতে নিয়ে সবাইকে রাস্তায় নামার যে নোঙ্রা পলিটিক্সের ছক আঁকা হয়েছিল, সেটাতে সাধারণ আওয়ামী নেতাকর্মীদের যে সায় ছিলনা ১০ নভেম্বরের কর্মসূচি বর্জন করে সে ম্যাসেজই তারা দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে এটাই প্রমাণিত হয়ে গেছে।