সংস্কার চ্যালেঞ্জে অন্তর্বর্তী সরকার


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 09-10-2024

সংস্কার চ্যালেঞ্জে অন্তর্বর্তী সরকার

অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক একই মুদ্রার এপিট-ওপিট! সাধারণ মানুষের কাছে এর পার্থক্য নেই। ওয়ান-ইলেভেনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে এসেছিল ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন যা চলছিল সুপারসনিক গতিতে। কিন্তু এবারের গণঅভ্যুত্থানের পরের ওই প্রক্রিয়ার যে অন্তর্বর্তী সরকার এরা একেবারেই সুশীতল ভূমিকা নিয়ে এগোচ্ছেন। আগের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে এদের মিল খুঁজে না পেয়ে অনেকেই হা-হুতাশ করছেন। তাছাড়া এ সরকারের সুশীতল ভূমিকায় ইতিমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব স্বাভাবিক রাষ্ট্রপরিচালনায়। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের যে সিন্ডিকেট সেটা আরো শক্তিশালী হয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তুলে ফেলার উপক্রম। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। প্রশাসনে চলছে নজীরবিহীন ঢিলেঢালা ভাব। যাতে মানুষের মধ্যে চরম আস্থাহীনতা শুরু। যে হাসিনা সরকারের পতন সেখানে শুধু শেখ হাসিনা ও তার কিছু মন্ত্রীবর্গই নেই। তার বসানো প্রশাসনে সবাই বহাল-এটা দেখতে পেয়ে গণঅভ্যুত্থানে যে কোটি কোটি মানুষের সাপোর্ট ছিল তারা হতাশ!

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা খুবই সরলমনে সবার ওপর বিশ্বাস রাখতে চাইছেন। আর এটাই এখন দুশ্চিন্তার কারণ। একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। তার চিন্তা-চেতনা অবশ্যই ওয়ান-ইলেভেনের পরের তত্ত্বাবধায়কের মতো হওয়ার কথা নয়। তাই বলে তিনি চুপ থাকবেন বা থাকছেন সেটা নয়। প্রশাসককে তিনি প্রশাসন শিখিয়ে তাকে দিয়ে কাজ করাতে চাইছেন। সম্ভব না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বহু অপশন তার হাতে। ফলে তার এ বোঝানোর পর্ব চলছে।

সদ্য শেষ করলেন তিনি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে সংলাপ। জানা গেছে, প্রতিটি দল যেসব প্রস্তাবনা বা পরামর্শ বা দাবি তুলেছেন তিনি সবটার সঙ্গেই একমত পোষণ করেছেন। বলেছেন এগুলো তার ও তার সরকারের চাওয়া। খুশি মনেই দলগুলো ফিরে গেছেন। এর মধ্যে ছোট্ট একটি কথাও তিনি বলে দিয়েছেন যে, তার প্রধান টার্গেট জাতীয় নির্বাচনটা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার। 

আর এটা করতেই একটা বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিলে কী হবে সেটা বুঝতে বাকি থাকবে না। আওয়ামী লীগের সাজানো প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন থেকে কোনোভাবেই ভালো কিছু বের হবে না। যা গত তিন টার্ম বের হয়েছে অনুরূপ। এজন্যই সংস্কার বড্ড জরুরি এবং সেটা করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকেই। সর্বশেষ সংলাপে সবকটি দলই এ সংস্কারে জোর দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টাও সে কাজটা দ্রুত করে ফেলার আশ্বাস দিয়েছেন।

নির্বাচনের রোডম্যাপের কী হবে?

বিএনপি ও সমমনা দলসমূহ যে রোড ম্যাপ চেয়ে এসেছিল সেটার একটা ম্যাপ ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছে সরকার। সময়টা সম্পর্কে বলে দিয়েছেন সেনাপ্রধান। ১৮ মাসের মতো। আপাতত অমন একটা টাইম ফ্রেমই থাকছে। এর মধ্যেই যে ছয়টি কমিশন কাজ করবে সংস্কারে তাদের কাজ সম্পাদিত হবে বলেই আশাবাদ। 

কিন্তু বিপত্তি বা শঙ্কা সংস্কারের এ সময়টুকু কী সরকার সুস্থতার সঙ্গে প্রশাসন ও ক্ষমতা ধরে রেখে চালাতে পারবেন? কারণ পতিত আওয়ামী লীগের হাতে পাচার ও চুরি হওয়া অঢেল অর্থ। সে অর্থ দিয়ে অনেক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করে দেশকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পরিণত করে দেওয়া হতে পারে। যা সম্ভব হবে পতিত সরকারের রেখে যাওয়া প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের যে সুবিধাভোগী ও বসানো ব্যক্তিরা আছেন তাদের যোগসাজশে। অন্তর্বর্তী সরকার যখন হুমকি দিয়ে এসেছে যে, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টের দোসরদের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের ছাড় হবে না। ফলে প্রশাসনে থেকে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করতে কী বিন্দুমাত্র পিছে থাকবেন?

ভারতে এখন অবস্থান করছেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। প্রতিনিয়ত তিনি যে পরিকল্পিত ফোনালাপ লিংক দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছে এটাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত। উৎসাহ পাচ্ছেন প্রশানের ভেতরে থাকা হাসিনা সরকারের অনুগতরা। এটাই চিন্তার কারণ। পার্শ্ববর্তী একটা দেশের রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ এমন সব মন্তব্য করছেন, যা মোটেও অন্তর্বর্তী সরকারের সহায়ক নয়। যা মূলত আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় ফেরানোর সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের ইঙ্গিত দিচ্ছে। টেনশন এখানেও।

এসব সামনে রেখে বিএনপির তরফ থেকে একটা দাবি-দাওয়া বাস সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেছে দলটির নেতৃত্বদানকারী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যেটা মূলত দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের দাবিগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে। 

দাবি নিয়ে তিনি বলেছেন, প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা হয় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের। যাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ছয় জন উপস্থিত ছিলেন। মির্জা ফখরুল দাবি করেন বেশ ভালো পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। ফখরুল বলেন, আমরা নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনা করেছি। নির্বাচন সংস্কারব্যবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরেছি। বলেছি, সব বাদ দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি বলেন, বিগত সরকার এনআইডি কার্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়েছিল। এটা একটা অর্ডিন্যান্স জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অধীনে থাকা থেকে বাতিল করতে বলেছি। একই সঙ্গে বলেছি বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যেন কোনো নির্বাচন কমিশনে না যায়। বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিটা সেক্টরই বাতিল করা হয়েছে এর সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিগত সরকার যেসব ভুয়া নির্বাচন পরিচালনা করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। 

মির্জা ফখরুল বলেন, দুই মাস হতে চলেছে অন্তর্বর্তী সরকারের। কিন্ত বিগত সরকারের প্রশাসনে স্বৈরাচারের দোসর হয়ে কাজ করছে, তাদের অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে। তাদের সরাতে হবে। জনপ্রশাসনে দায়িত্ব দেওয়া জেলা প্রশাসকের ব্যাপারে যে অভিযোগ উঠেছে, তাদের বাতিল করতে বলেছি। মির্জা ফখরুল সবচেয়ে বড় অভিযোগের তির ছুড়েছেন খোদ ইউনূস নেতৃত্বে যে উপদেষ্টা পরিষদ সেখানকার কয়েকজন উপদেষ্টার বিষয়ে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দু-একজন রয়েছেন, যারা বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিলেন তাদের সরাতে বলেছি। 

মির্জা ফখরুল গুরুত্বপূর্ণ যে ইস্যুটি তুলেছেন সেটা বিচার বিভাগ। কারণ বিচার বিভাগে এখনো আগের সব নিয়োগপ্রাপ্তরা বসে আছেন। বিশেষ করে হাইকোর্ট বিভাগে বেশির ভাগ নিয়োগ ছিল দলীয়ভিত্তিতে। প্রায় ৩০ জন রয়েছে হাইকোর্টের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। ফখরুল বলেন, তাদের সরাতে বলেছি। অপসারণ করার কথা বলেছি। 

ইদানীং দেখা যায়, সুর্নিদিষ্ট অভিযোগের বিরুদ্ধে অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু এদের আবার জামিন দেওয়া হচ্ছে। এটা বিগত সরকারের অনুসারীদেরই ইন্ধনে হচ্ছে বলে বিএনপি মহাসচিব মনে করছেন বলে প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা হয়েছে বিগত সরকার তার প্রতিপক্ষকে দমনপীড়নে তাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে পরামর্শ দিয়েছেন উপদেষ্টাকে। 

বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিভিন্ন আমলা ও মন্ত্রীরা পালিয়ে যাচ্ছে, কার সহায়তায় পালাচ্ছে, সেটা খতিয়ে দেখার কথা বলেছি। এখানে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিতকরণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেন, ভারতে থেকে শেখ হাসিনা প্রচারণা চালাচ্ছে, সেটা ভারত সরকারের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি। কারণ একটি দেশে আশ্রয় নিয়ে স্বৈরাচারী সরকার দেশের অভ্যন্তরে বিবাদ উসকে দিচ্ছে। 

একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ যেসব স্থানে ঝুট ঝামেলা তৈরি হচ্ছে, এর ইন্ধনদাতা কারা সেটা বের করার দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব। একই সঙ্গে বিগত সময় ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুম খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করার দাবি দেওয়া হয়েছে। 

মির্জা ফখরুল অভিযোগ করে বলেন, জাতিসংঘের একটি দল এসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা হত্যাকা-ের ফ্যাক্টচেক করতে, মোটিভ উদ্ধারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক তাদের সেভাবে সহায়তা করা হচ্ছে না। এটা ভয়ানক অপরাধ। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে একটি মহল বিগত সরকারের নির্দেশনায় পরিকল্পিতভাবে জনগণকে উসকে দিচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এরা মিথ্যা, কিন্তু এ প্ররোচরণা করছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি। 

সবশেষ

বিএনপির এসব দাবি পরবর্তীতে সব দলের দাবির প্রতিধ্বনি। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তরিক পরিবেশে কথাগুলো শুনেছেন। বলেছেন এগুলো আমাদেরও কথা, আমাদেরও দাবি, আমরা এগুলো বাস্তবায়নে আন্তরিক। একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রাখতে আগ্রহী বলেও জানান দিয়েছেন। যাতে সংস্কার প্রক্রিয়া যথাযথ এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়েই করা যায় এ আশাবাদ প্রফেসর ইউনূসের।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)