প্রতিনিয়ত কঠোরতা প্রকাশ পাচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চেহারা। উপদেষ্টাদের শপথ গ্রহণের পর নিজেদের ঘুছিয়ে নিতে সামান্য সময়টুকুও পাননি। এরই মধ্যে ভয়াবহ এক জুডিশিয়াল ক্যু’র ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে ছাত্রজনতা। এরপরই আর ফুরসৎ নেই। প্রধান বিচারপতিসহ ঐ সেক্টরের আওয়ামী লীগ সরকারের দোসরদের সরিয়ে স্বস্তি আনার পর আইনশৃখংলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থায়ও পরিবর্তন আনা শুরু হয়। এ প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদেও চূড়ান্ত হয়েছে এবং আহসান এইচ মনসুরকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এমন ঢামাডোলের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। শুধু তিনি নন। রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ মোট ৭ জন। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে। বিশেষ করে যারা শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছে অর্থাৎ দেশ ছাড়তে পারেননি, আত্মগোপনে। প্রতিনিয়ত ধরা পরে যাওয়ার আতঙ্ক বিরাজ করছে তাদের মধ্যে। সাধারণ নেতাকর্মী সমার্থকদের মধ্যেও উৎকন্ঠা। যার প্রমাণস্বরূপ বিগত সরকারের দুই হেভিওয়েট সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হক নৌ-রুটে সদরঘাট দিয়ে ছদ্মবেশে পালাতে যেয়ে আটক হয়েছেন পুলিশের কাছে। এসময় প্রকাশ হওয়া ছবিতে দু’জনকে লুঙ্গি পরিহিত ও সালমান এফ রহমানকে দাড়ি সেভ অবস্থায় ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরতে দেখা যাচ্ছে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক দোকান মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা মামলার আবেদন সরাসরি এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
গুলিতে নিহত মুদি দোকান মালিক আবু সায়েদের ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ এস এম আমীর হামজার (শাতিল) দায়ের করা মামলা গ্রহণ করে ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী গত ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
ঢাকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বিডি নিউজ তাদের অনলাইনে জানায়, দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় দায়ের করা এ মামলা আদালত আমলে নেওয়ায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে।
মামলায় যারা আসামী
হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ এবং যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে হাবিবুর রহমানকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের অজ্ঞাতনামা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের এ মামলায় আসামি করার আবেদন করেছেন মামলার বাদী। ৫ অগাস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনারীদের ঢাকামুখী লংমার্চের মধ্যে অপরাহ্নে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর তার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম মামলা।
কী বলা আছে এজাহারে
মুদি দোকানদার আবু সাঈদের হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়, “কোটা আন্দোলনের মধ্যে গত ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরে বছিলার ৪০ ফিট এলাকায় ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করছিল। সেখানে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। রাস্তা পার হওয়ার সময় স্থানীয় মুদি দোকানি আবু সায়েদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।” মামলার বাদী এজাহারে বলেন, নিহত আবু সায়েদের পরিবার অত্যন্ত গরীব। তার পরিবার পরিবার থাকে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায়। তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না। এ কারণে সচেতন নাগরিক হিসেবে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে তিনি আদালতে মামলা করেছেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলন কঠোর হস্তে দমনের নির্দেশ দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে পুলিশের আইজিপি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধীন পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে মিছিলে গুলি চালান। পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কাজেই এর বিচার হওয়া প্রয়োজন।”
অভিযোগে লেখা হয়- মামলার ১ নম্বর আসামি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এজাহারে তার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি আন্দোলন ‘শক্ত হাতে’ দমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
২ নম্বর আসামি আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দিয়েছেন। ৩ নম্বর আসামি সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন, ৪ নম্বর আসামি ডিএমপির (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ, ৫ নম্বর আসামি ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং ৬ নম্বর আসামি যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে তাদের অধীন পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেন।
এছাড়া বাকি মামলার পাঁচ নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করার নির্দেশ দেন বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে। আর অন্য ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর নির্দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটান বলেও এজাহারে বলা হয়েছে।
“ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ ছাত্র-জনতাকে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে হত্যা করেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এসব হত্যার বিচার হওয়া আবশ্যক। আবু সায়েদ হত্যার তদন্ত হলে অজ্ঞাতপরিচয় আরও তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যদের নাম উঠে আসবে।”
ফৌজদারি মামলার অভিজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলেন, “দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা আমলযোগ্য। এসব মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে। সুতরাং আদালত যখনই মামলার আবেদনটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন, তখনই স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তাতারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। এ ধারাটি জামিনযোগ্য নয় এবং আপোষ যোগ্য নয়। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।”
মামলার অপর একটি ধারা হলো, দণ্ডবিধির ১৪৯ ধারা। এ ধারা অনুযায়ী বেআইনি সমাবেশে থাকা কোনো সদস্য কোনো অপরাধ করলে অন্য সদস্যরাও একই অপরাধে দোষী হবে।
আমিনুল গণী টিটো বলেন, “এ অপরাধটির জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা গেলে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারে, অন্যথায় নয়। অর্থাৎ পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাইলে তা পাবেন না।
“অপরাধটির জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়ার মত বা সমন দেওয়ার মত পরিস্থিতি থাকলে তা আদালত দিতে পারবেন। আর অপরাধটি মীমাংসাযোগ্য বা আপোষযোগ্য নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী এ ধারায় জামিন মিলতে পারে। ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, যে প্রকৃতির অপরাধ হয়েছে সেই প্রকৃতির সাজা হবে।” এ মামলায় আরেকটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যেটি দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা। এ ধারার সংজ্ঞা হল, ‘সাধারণ অভিপ্রায়’। অর্থাৎ কিছু মানুষের একই ধরনের ইচ্ছা কিংবা বাসনার দরুন কোনো অপরাধমূলক কাজ।
আনিসুল ও সালমান এফ রহমান আটক
ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের সাবেক হেভিওয়েট মন্ত্রী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে পালানোর সময় আটক করেছে পুলিশ। ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মাইনুল হাসান জানিয়েছেন, রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। নিউমার্কেট থানায় দায়েরকৃত মামলায় সাবেক মন্ত্রী পদমর্যাদার এ দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক পালানোর চেষ্টা করছেন। গোয়েন্দা সূত্রে এমন খবরে রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় অভিযানে যায় পুলিশের একটি দল। পরে নৌপথে পালানোর সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। নিরাপদ রুট মনে করেই আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট এ দুই নেতা নৌপথে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর পরপরই শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা আড়ালে চলে যান। সালমান এফ রহমানের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর এলেও ভারতীয় গণমাধ্যমে এর আগে দাবি করা হয়েছিল তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশ ছাড়েন। কিন্তু আটক হওয়া দুই মন্ত্রী ও উপদেষ্টার প্রকাশ হওয়া ছবিতে লুঙ্গি পরিহিত দেখা যায়। এরমধ্যে সালমান এফ রহমান তার দীর্ঘদিনে রাখা দাড়ি সেভ করে নিজের চেহারায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন বলে ছবিতে দেখা যায়।
আইনজীবী আনিসুল হক ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা) থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওইবারই তাকে আইনমন্ত্রী করা হয়। এরপর থেকে তিনি আইনমন্ত্রীর পদে ছিলেন।
সালমান এফ রহমান বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সালমান এফ রহমান ঢাকা-১ আসন থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন। পরে তাকে নিজের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।