শিরোনামটা চমকে উঠার মতোই। কিন্তু অবাস্তব নয়। পরম পরাক্রান্ত বাংলাদেশের সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন পরিণতি হতে পারে এক সপ্তাহ আগেও তার কোন চরম শত্রুও তা কল্পনা করতে পারতেন না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমনই যে তা অনেকটাই বাস্তবের কাছাকাছি।
আশ্রয়হীন শেখ হাসিনা!
শেখ হাসিনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন তাকে আশ্রয় দিতে ভরসা পাচ্ছেন না। অথচ শেখ হাসিনা তার নিজের গদি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ভারতের কাছে দেশকে বিকিয়ে দিতে সামান্যতম দ্বিধাও করেননি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে মোমেন একসময় বলেছিলেন- ভারতের সাথে আমাদের স্বামী-স্ত্রী’র মতো সম্পর্ক। দুদেশের সম্পর্কের গভীরতা বুঝাতে তিনি সম্ভবত এই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পর্কের এই গভীরতা কোন কাজেই আসেনি।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘হাসিনার বন্ধুত্ব নাকি কূটনৈতিক বন্ধুত্ব’ কোনটা রাখবে এজন্য দোটানায় ভারত। কারণ বিক্ষোভ দমনে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ভোটাধিকার ও বাক স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লংঘন, দুর্নীতি ও অর্থপাচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, ঋণের নামে ব্যাংক লুটের সুযোগ দেয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। মাথার উপর খাঁড়ার মত ঝুলে আছে পিলখানা হত্যাকান্ড, শাপলা চত্বর হত্যাকান্ড ইত্যাদি। ১৬ জুলাই আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে মারা যায় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ। সরকারের বর্বর দমন পীড়নের প্রতিবাদে নানা ধাপে প্রায় চারশ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর জেরে হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করতে পারে।
ফলশ্রুতিতে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। যেজন্য তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিলে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নতুন সরকার শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে।
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দেশত্যাগী হাসিনার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের দাবিও জানিয়ে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে হাসিনার বিষয়ে ভারতের অবস্থান হবে- শ্যাম রাখি না কুল রাখি। ফলে নয়াদিল্লীতে হাসিনা আদৌ থাকতে পারবেন কিনা তা নিয়েও ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।
হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় না দেয়ার পক্ষে আরো যুক্তি রয়েছে। তা হলো, পরিকাঠামো এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রচুর ভারতীয় বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক বা যাঁরাই দেশ চালাক ভারতকে নিজের স্বার্থে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাসিনার জন্য কোনভাবেই যেন কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সেটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে মোদীকে।
দিল্লী-ঢাকা বন্দী বিনিময় চুক্তি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হলেও নয়াদিল্লী ও ঢাকার মধ্যে কোন বন্দী বিনিময় চুক্তি ছিল না। ফলে দু দেশের মধ্যে থাকা অনুপ্রবেশকারীদের নিজ নিজ দেশের বিচার ব্যবস্থার অধীনে আনা সম্ভব হতো না। এই জটিলতা চলে চার দশকের বেশি সময়। ২০১৩ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ তাদের দৃষ্টিতে “দোষী” ব্যক্তিকে একে অন্যের মধ্যে বিনিময় করতে পারে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশে বন্দী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে নিয়ে যায় ভারত। আবার একইভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামী মাজেদকে ঢাকায় নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে হাসিনা সরকার। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! সে আইনের ফাঁদেই হয়ত পড়তে যাচ্ছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন শেখ হাসিনা চাইলেও ভারত তাকে তার দেশে আশ্রয় দিতে সক্ষম হবে না। তাকে বসবাসের জন্য এমন কোন দেশ বেছে নিতে হবে যার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই।
শেখ হাসিনা তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার স্বার্থে পরবর্তীতে ভারতের সাথে এই বন্দী বিনিময় চুক্তিতে আরো সংশোধনী আনেন। চুক্তি অনুযায়ী কারাদন্ড না হলেও শুধুমাত্র গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেই বন্দি বিনিময় করতে পারবে দু’দেশ। চুক্তি সংশোধনের ফলে এখন থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের আদালত যে কোনও আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করলেই সংশ্লিষ্ট আসামি বিনিময়যোগ্য হবে।
উল্লেখ্য, এর আগে শুধু ওয়ারেন্ট থাকলেই বন্দি বিনিময় করা যেত না। সেক্ষেত্রে প্রমাণ ও আদালতের নির্দেশ থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। মূলত এটা ছিল জটিল প্রক্রিয়া। নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে এটাকে সহজ করা হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতে বসবাসকারী কোনও বাংলাদেশির বিরুদ্ধে যদি বাংলাদেশের আদালত ওয়ারেন্ট জারি করে তাহলে ভারত সরকার তাকে (আসামি) বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে। একইভাবে ভারত সরকারও ওয়ারেন্টভুক্ত কাউকে চাইলে বাংলাদেশ তাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য।
রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনার অবসর নেয়া প্রসঙ্গ
ক্ষমতাচ্যুত হবার পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিবিসির সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরতে চান না। কথাটা ঘুরিয়ে বল্লে বলা যায়, তিনি চাইলেও আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন না। কারণ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখন শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়। কারণ জনরোষের মুখে শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তার বিদেশ পালিয়ে যাওয়া মানতে পারছেন না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, তিনি যদি দেশ ছেড়ে যাবেনই তাহলে শেষ মুহূর্তে দলের নেতা কর্মীদের কেন আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি দাঁড় করালেন? তাদের অনেকের ভাষ্য শেখ হাসিনার একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত এবং জেদের কারণে দল ও নেতা কর্মীরা বিপদে পড়েছেন। তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও দলীয় কর্মীদের চরম বিপদের মুখোমুখি রেখে গেছেন। তারা এখন হতাশ ও বিপর্যস্ত। তিনি একজন যোগ্য নেতার ভূমিকা পালন করতে পারেননি।
উল্লেখ করা যেতে পারে সেনা শাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলেও তিনি তার কর্মীবাহিনীদের ফেলে সুযোগ থাকলেও কোথাও পালিয়ে যাননি। কর্মীদের আস্থা ছিলো তাঁর উপর। যেজন্য দীর্ঘদিন কারাভোগের পরও ফিরে এসে তিনি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে পেরেছিলেন।
অপরদিকে শেখ হাসিনার বেলায় ঘটেছে উল্টোটি। নেতা কর্মীদের কাছে তিনি আস্থা হারিয়েছেন। যদি তিনি ভবিষ্যতে রাজনীতিতে ফিরতেও চান তাহলে দলে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।